যুক্তরাষ্ট্রে যৌন ব্যবসায় বিক্রি হওয়া শিশুদের কথা

প্রতি রাতেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে শত শত শিশু। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে দারিদ্র্য, বঞ্চনা আর শোষণের শিকার শত শত শিশুকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এক অন্ধকার জগতে। যে জগৎ থেকে আর ফেরার পথ থাকে না। নানা দেশ থেকে পাচার হওয়া কম বয়সী মেয়েদের যৌন ব্যবসায় নিয়ে আসার কথা হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নাগরিকই জানেন। কিন্তু তাদের খুব সংখ্যকই জানেন যে, যৌনকর্মী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া ওই মেয়ে শিশুদের একটা বড় অংশ খোদ যুক্তরাষ্ট্রেরই সন্তান।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই বলছে, দেশটিতে শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু গত বছরই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকা থেকে ফাঁদে ফেলে যৌন ব্যবসার দিকে ঠেলে দেওয়া অন্তত ৬০০ শিশুকে উদ্ধার করেছে এফবিআই।
‘সেক্স ট্রাফিকিং’ বা যৌনতার জন্য মানবপাচারের কথা শুনলে চোখের সামনে যে চিত্র ভেসে ওঠে তার চেয়ে যৌনতার জন্য বিক্রি করা এই মার্কিন শিশুদের গল্পটা ভিন্ন। যৌন ব্যবসায় নামানোর জন্য দুনিয়ার নানা দেশ থেকে সমুদ্র আর স্থলপথে পাচার করে মার্কিন মুল্লুকে নিয়ে আসা হয় বিপুলসংখ্যক মেয়েকে। মেক্সিকো এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকেও আনা হয় অনেক কমবয়সী মেয়েদের। এই চিত্রগুলো সবারই জানা। কিন্তু খোদ মার্কিন মুল্লুকে জন্ম নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সন্তানদের যৌন কর্মীর জীবনে ঠেলে দেওয়া হয় তাদের গল্পটা সব সময় যেন আড়ালেই থাকে।
খুব অল্প বয়সেই বঞ্চিত আর অবহেলিত এই শিশুরা যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া শুরু করে। একপর্যায়ে আর ফেরার পথ থাকে না তাদের। তাদের থেকে যেতে হয় যৌন ব্যবসার অন্ধকার জগতে। তাদের রক্ষায় যাদের এগিয়ে আসার কথা অনেক সময় তারাই তাদের বিচার করতে শুরু করেন। তবে, ভুক্তভোগীরা বলেছেন, অনেক সময় কিছু ভালো মানুষ, কিছু অপরিচিত লোকও এগিয়ে এসেছেন তাদের সাহায্যে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকেই অনেক সময় তাদের সহায়তা দিয়েছেন।

যৌন নিপীড়নের শিকার এমন ভাগ্যাহতদের নিয়ে কাজ করছে ‘ব্রেকিং ফ্রি’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় এ সংগঠনের সেবা কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন অনেক সাবেক যৌনকর্মী। সংগঠনটি জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে যুক্ত সাবেক যৌনকর্মীদের অর্ধেকেরও বেশি ১৮ বছর বয়সের আগেই ওই পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এমন এক নারী জানিয়েছেন, মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার এক চাচি তাকে কিনে নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘চাচি আমার মাকে ৯০০ ডলার দেন। আমাকে বলেন, চলো তোমাকে শপিং মলে নিয়ে যাচ্ছি।’ চাচি এরপর তাকে মাদক ব্যবসায়ীদের বাসায় নিয়ে যেতেন আর সেখানে তাকে মাদক সেবন করিয়ে ধর্ষণ করা হতো। ‘তিনি আমাকে রেখে চলে যেতেন, এমন ভাব করতেন যেন আমি ওলটপালট হয়ে গেছি আর সেখানেই থাকতে চাচ্ছি।’ স্মৃতিচারণা করে ওই নিপীড়নের শিকার ওই নারী বলেন, ‘খুব শিগগিরই আমার মনে হতে শুরু হয়েছিল যে, এগুলো যেন আমারই দোষ আর এসব যেন আমিই বেছে নিয়েছি।
আরেক নারী জানিয়েছেন, ১৭ বছর বয়সে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমি নেশা করতে চাইতাম।’ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে শুরু করি।’ পরের দিকে নেশার জোগান বজায় রাখতে আরও বেশি টাকার প্রয়োজনে তিনি বিশেষায়িত বিজ্ঞাপনের ওয়েবসাইট ব্যাকপেইজ ডটকম এ কাজ করতে শুরু করেন।
তৃতীয় আরেক নারী জানান, ১৪ বছর বয়সে তিনি অপহরণের শিকার হয়েছিলেন। কিশোরী বয়সে প্রেমে পড়েই ওই যুবকের সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ওই যুবক প্রায় দুই বছর আটকে রাখার পর তাকে ছেড়ে চলে যায়।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ব্রেকিং ফ্রি তাদের সদস্যদের জন্য নিয়মিত মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে থাকে। এখানে সঞ্চালক হিসেবে কাজ করেন জেনি গেইনস। জেনি বলেন, ‘অনেকেই কম বয়সী মেয়েদের বিভ্রান্ত করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে।’ এমন এক আলোচনাতেই আরেক নারী বলেন, ‘আমাকে নিপীড়নকারী জানতেন যে আমার বয়স ১৪। কিন্তু তিনি প্রথমে বলতে চাইছিলেন যে, আমার বয়স আসলে আঠারোই। শেষে আমার বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরও তিনি নিপীড়ন থামাননি। বরং আগের চেয়ে করে আমাকে চাইতে শুরু করেন।’
নিপীড়নের শিকার হয়ে কিংবা প্রতারণা ফাঁদে পড়ে একবার যৌন কর্মীর জীবন বেছে নিলে অনেক সময়ই আর পেছনে ফেরার পথ থাকে না। এমন এক নারী জানান, অনেক দিন ধরেই তিনি এই পেশা ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখানকার উপার্জন ছাড়া মেয়ের স্কুলের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই তাঁর। তিনি বলেন, ‘২২ বছর বয়সে আমি ওই কাজ করা বন্ধ করি। আমার প্রথম ছেলের জন্ম হয়।’ কিন্তু এরপরও তাকে মাঝে মধ্যে ওই পেশায় যেতে হয়েছে। এখন চার সন্তানের জননী হওয়ার পরও তাঁর জীবনের এই সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি।
শিশু বয়সেই যৌনতার জন্য বিক্রি করে দেওয়া এই নারীদের অনেকেই ‘স্বাভাবিক’ জীবনে ফিরে যেতে চান। এক নারী বলছিলেন, ‘আমি আমার স্বাধীনতা ফিরে চাই। আমি আমার ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করে সময় কাটাতে চাই, আমার জীবনটা যাপন করতে চাই, একটা স্বাভাবিক জীবন।’ কিন্তু নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যাদের জীবনের এই পথে হাঁটতে হয়েছে তাদের অনেকের পক্ষেই আর ফেরা সম্ভব হয় না। এমন এক ভুক্তভোগী যেমন বলছিলেন, ‘বারো বছর বয়সে কেউ এটা বেছে নিতে পারে না, এটা কেউ বেছে নেয় না।’
(বিবিসি অবলম্বনে)