
রায়হানের চাকরির দুই বছর হলো। তার মা এসে বললেন, ‘বাবা, চাকরি হইল, এবার বিয়ে কর।’
মায়ের কথা শুনে এককথায় ‘না’ করে দিল রায়হান। কিন্তু মা আমেনা বেগম কি ছাড়ার পাত্র? অতএব তিনি সকাল-সন্ধ্যা-রাত—এই তিন বেলায় অন্তত ১৭ বার একমাত্র ছেলেকে বিয়ের কথা মনে করিয়ে দিতে লাগলেন। যেমন: অফিসে যাওয়ার সময় রায়হান তার চাবি খুঁজে পাচ্ছে না। অনেক দিনের অভ্যাসবশত সে মাকে ডাক দিল, ‘আম্মা, চাবি পাই না। চাবি কই?’
মা উত্তর দিলেন, ‘আজ যদি একটা বিয়ে করতি, তাহলে চাবি হারাইতি না।’
চাবির সঙ্গে বিয়ের কী সম্পর্ক, সেটা ভাবতে ভাবতে চাবি ছাড়াই বেরিয়ে যায় রায়হান। তবে মুক্তি মেলে না। দুপুরে সে মাকে ফোন করে, মা ঠিকঠাক খেয়েছে কি না জিজ্ঞেস করার জন্য, ‘আম্মা, খাইছ?’
: আজ যদি তোর একটা বউ থাকত, তাহলে আমার খাওয়া নিয়ে এত টেনশন করা লাগত না!
রায়হানের টেনশন আরও বেড়ে গেল, যখন রাতে ফিরে সে মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মা, কী রান্না করছ?’
মা বললেন, ‘আর রান্না! আজ যদি তোর বউ থাকত, তাহলে কত ভালো-মন্দ খাওয়া যেত।’ কোনো বাক্য ব্যয় না করে রায়হান তার ঘরে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই দেখে, দেয়ালের ঘড়িটা বন্ধ হয়ে আছে। বিষয়টা সে চেপে গেল। চেপে না গেলে জানা যেত, আজ যদি তার বউ থাকত তাহলে ঘড়িটা বন্ধ হতো না!
২.
রায়হানের ছোট বোনের নাম ফারিহা। রায়হান সকালে ঘুম থেকে উঠতেই সে বলল, ‘ভাইয়া, সন্ধ্যায় আমার সাথে একটু শপিংয়ে যাবি?’
: না, পারব না!
: হুহ্, আজ যদি তোর একটা বউ থাকত, তাহলে তাকে নিয়েই শপিংয়ে যেতাম! নিজেও যাবি না আবার বিয়েও করলি না। ঘোড়ার ডিম!
কথা না বাড়িয়ে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল রায়হান। বাবা ইফতেখার আহমেদ বসে আছেন। রুটির কোনা ছিঁড়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তো বিয়ের ব্যাপারে তুই কিছু ভেবেছিস?’
: হ্যাঁ।
: গুড! কী ভাবলি?
: আমি বিয়ে করব না!
: শাবাশ ব্যাটা! একদম বাপের মতো হয়েছিস। আমিও প্রথম প্রথম এমন সাহসী ছিলাম!
: তারপর?
: আমাকে দেখ, এটাই হলো ‘তারপর’!
রায়হান সামান্য শঙ্কিত হলো কি না কে জানে! তবে খুব ধীরস্থির হয়ে সে অফিসের উদ্দেশে বেরোতে গিয়ে খুক খুক করে দুইটা কাশি দিল। শুনেই মা রান্নাঘর থেকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শরীর খারাপ?’
রায়হান মাথা নেড়ে বলল, ‘শরীর খারাপ না। একটু ঠান্ডা লাগছে।’
মা যেন প্রস্তুত ছিলেন ওই কথাটা বলার জন্য, ‘আজ যদি তোর বউ থাকত...!’
৩.
যে যত কথাই বলুক, রায়হান বিয়ে করবেই না। কিন্তু পরিবার তো জোঁকের মতো লেগে আছে। তাই এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজতে বন্ধুকে সব খুলে বলে সে। বন্ধু অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত জানায়, ‘তোর আসলে বিয়ে করে ফেলা উচিত।’
কলিগের কাছে সাজেশন চাইলে তিনিও বললেন, ‘আপনার আসলে বিয়ে করে ফেলা উচিত।’
অবস্থা এমন হয়েছে যে রায়হান যদি বলে, ‘ঘুম হয়নি।’ তাহলে সমাধান হবে এ রকম—
: বিয়ে করে ফেল, সব ঠিক হয়ে যাবে।
: মন খারাপ।
: বিয়ে করলে ঠিক হয়ে যাবে।
: শরীর খারাপ লাগছে।
: বিয়ে না করলে তো এমন লাগবেই।
: রাস্তায় এত জ্যাম! মেজাজ খারাপ।
: বিয়ে করলে এমন হতো না!
রায়হানের সত্যিই অভিমান হয়, তবে সেটা মেডিকেল সায়েন্সের ওপর। কত রকমের ওষুধ আবিষ্কার হয়েছে দুনিয়ায়। অথচ পুরুষের সর্বরোগের এক সমাধান যে বিয়ে, এটা তারা আবিষ্কার করতে পারেনি!
৪.
বাসায় ফিরে রায়হান অবাক হয়। কারণ, তার খালা, ফুফু, মামিসহ ছয় সদস্যবিশিষ্ট নারী টিম এই মুহূর্তে তাদের বাসায়। কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর বড় খালা এসে রায়হানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা, আমার কাছে দুই-তিনটা পাত্রী আছে। সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং দেখতে শুনতে ভালো। তুমি পছন্দ করলেই বিয়ে।’
: জি খালা। ছবি দেখান।
রায়হান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবি দেখে বলল, ‘খালা, আমার তো তিনটা মেয়েকেই পছন্দ হয়েছে। কী করব?’
বড় খালা সরে গেলেন। এগিয়ে এলেন ছোট খালা, ‘শোন রায়হান, তোর একটা ফুটফুটে বউ হবে। এইটা আমাদের স্বপ্ন ছিল।’
: আমার কোনো বউ নাই, এটাই আমার স্বপ্ন!
ছোট খালা ধরাশায়ী হয়ে যখন পিছু হটলেন, তখন প্রেক্ষাপটে আগমন একমাত্র ফুফুর। তিনি কথা বলতে বলতে আবেগে কেঁদে দিলেন। কান্নার কারণ, তাঁর একটা ছেলে নেই। আজ যদি তাঁর একটা ছেলে থাকত, সে-ও হতো রায়হানের বয়সী।
এ পর্যায়ে রায়হান ফুফুকে থামিয়ে বলল, ‘জি জি, বুঝছি। আমি বিয়ে করলে আপনার একটা স্বপ্ন পূরণ হবে, এই তো?’
ফুফুর মুখে হাসি ফুটল। রায়হান সিদ্ধান্ত নিল, এখানে সে আর থাকবে না। চলে যাবে যেখানে খুশি। কিন্তু চাইলে কি আর চলে যাওয়া যায়?
৫.
ক্রমেই ঘটনা কঠিন আকার ধারণ করল। রায়হান সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল, আব্বাস ভাই হাজির। আব্বাস ভাই তার খালাতো ভাই। যিনি একাধারে ভাই, তবে তাঁর ওঠা-বসা মামা-খালাদের মতো মুরব্বিদের সঙ্গে। আব্বাস ভাই এসেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে, তুই নাকি বিয়া করতে চাইতাছস না?’
: হ্যাঁ।
: ক্যান, বিয়া করবি না ক্যান?
: এমনিই। সময় হয় নাই।
: না, তর অন্য কোনো সমস্যা থাকলে বল।
‘কী সমস্যা!’ জিজ্ঞেস করেই রায়হান চিন্তায় পড়ে গেল। আব্বাস ভাই তো গভীর কোনো সংকটের কথা বোঝাচ্ছেন।
: সমস্যা থাকে না মানুষের? থাকে। এ জন্য ডাক্তার আছে, কবিরাজ আছে।
: আমার কোনো সমস্যা নাই।
: সমস্যা লুকালে কী সমাধান হবে? আমি জানি, এমন সমস্যায় লজ্জা পাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু লুকালে তো হবে না। চল, আমার পরিচিত একজন ডাক্তার আছে। বিকালেই যাই। সব খুলে বলবি, দেখবি, এক সপ্তাহের মধ্যে তুই বিয়ের জন্য প্রস্তুত!
৬.
ততক্ষণে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে রটে গেছে, রায়হানের কিঞ্চিৎ সমস্যা! আর এ কারণেই সে বিয়েবিমুখ। কিন্তু আব্বাস ভাই ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করছেন, তাই টেনশনের কিছু নেই। সকালে রায়হানের বাকি কাজিন-কুজিনরা ফোন করে সমবেদনা জানাল। অবশেষে ‘এ জীবন আর ভালো লাগে না’ বলে রায়হান মনে মনে বিয়ে করার কথা ভেবে ফেলল। কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করেছে সে মরে নাই, রায়হান বিয়ে করে প্রমাণ করবে, তার কোনো সমস্যা নাই।