যে কথা যায় না বলা...

.
.

পারিবারিক সহিংসতার শিকার এক নারী আদালতে এসেছেন সুরক্ষা চাইতে। আদালতে আরজিটি পড়ে জানা গেল, বিচারপ্রার্থী নারীর বিয়ে হয়েছে চার বছর হলো। তাঁর গর্ভে এখনো সন্তান আসেনি বলে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে মানসিকভাবে অত্যাচার করেন। কথায় কথায় তাঁকে গালমন্দ এবং মা-বাবাকে জড়িয়ে বিভিন্ন অপবাদ দেন। স্বামী কথায় কথায় তালাকের হুমকি দেন। তিনি এ অপবাদ আর বঞ্চনা সহ্য করতে পারছেন না। আবার তালাকও নিতে পারছেন না। কারণ, তাঁর বাবা-মা বেঁচে নেই। কোথায় নেবেন তিনি আশ্রয়। এ অবস্থায় তিনি আদালতে আশ্রয় চাইতে এসেছেন।
দুই.
বিয়ের চার মাস না যেতেই গর্ভবতী হয়ে পড়েন মিশু (ছদ্মনাম)। কিন্তু তাঁর স্বামী এত তাড়াতাড়ি সন্তান চান না। তাঁর স্বামীর একটাই কথা—দুই বছরের আগে কোনো সন্তান নয়। মিশু তখন এক মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন তাঁর স্বামী ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে একটি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে গর্ভপাত করাতে বাধ্য করেন। মিশু নীরবে সহ্য করে যান। কাউকে বলতে পারেন না এ কথা। আইন-আদালতের পথও তাঁর জানা ছিল না।

তিন.
একটি মানবাধিকার সংস্থায় আশ্রয় নেওয়া একজন স্ত্রীর একটি আবেদন থেকে জানা যায়, তাঁর স্বামী মানসিকভাবে বিকৃত রুচির লোক। প্রতি রাতেই স্ত্রীকে অস্বাভাবিকভাবে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করতেন। এ কারণে স্ত্রী তালাক চান কিন্তু তাঁর কাবিননামায় তালাকের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি বলে পারিবারিক আদালতে আশ্রয় নিতে চান।
ওপরের ঘটনাগুলোর মতো অনেক নারীই এ রকম যন্ত্রণার মুখোমুখি হন। অনেকে সহ্য করে যাচ্ছেন নীরবে। কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। বিভিন্ন ছোটখাটো ব্যাপারে অনেক নারীকে তাঁর স্বামী বা স্বামীর পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে নানা যন্ত্রণার শিকার হতে হচ্ছে। কখনো যৌতুক, কখনো সন্তান না হওয়া কিংবা বিভিন্ন অজুহাতে অনেক স্ত্রীই এ রকম অত্যাচারের শিকার হন প্রতিদিন। কিন্তু এ রকম ঘটনার শিকার হলে কি নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে? এ নির্যাতন কি অপরাধ? কেউ যদি আইনের আশ্রয় নিতে চান, আসলে কি কোনো প্রতিকারের উপায় আছে? এর উত্তর হচ্ছে আছে। এ রকম নির্যাতন প্রচলিত আইনে মানসিক নির্যাতনের আওতায় পড়ে। এমনকি গর্ভপাত এবং অস্বাভাবিক সম্পর্কে বাধ্য করা শারীরিক নির্যাতনের আওতায়ও পড়ে।

আইন কী বলে?
দণ্ডবিধির ৩১৩ ধারায় নারীর সম্মতি ছাড়া গর্ভপাত করানোকে একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে ধরা হয়েছে। এর জন্য যাবজ্জীবন বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান আছে। আবার দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ১৪ বছরের নিচে স্ত্রীর সম্মতিসহ যৌন সহবাসও ধর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে যদিও এখনো বৈবাহিক ধর্ষণ বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি কিন্তু অস্বাভাবিক অপরাধের শাস্তির বিধান আছে। দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো পুরুষ বা নারীর সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস করে, তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ জরিমানা হতে পারে।
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০-এ স্পষ্ট করে মানসিক নির্যাতনের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী ‘মানসিক নির্যাতন’ বলতে মৌখিক নির্যাতন, অপমান, অবজ্ঞা, ভীতি প্রদর্শন বা এমন কোনো উক্তি করা, যার মাধ্যমে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা বোঝানো হয়েছে। হয়রানি অথবা ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ অর্থাৎ স্বাভাবিক চলাচল, যোগাযোগ বা ব্যক্তিগত ইচ্ছা, মতামত প্রকাশের ওপর হস্তক্ষেপের মতো বিষয়গুলোও মানসিক নির্যাতনের আওতায় পড়বে।

আইনের আশ্রয় যেভাবে
অবৈধ গর্ভপাত বা অস্বাভাবিক অপরাধের শিকার হলে বিচারিক (জুডিশিয়াল) ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গিয়ে মামলা করা যায় আবার নিকটস্থ থানায় এজাহার হিসেবেও মামলা করা যায়। আর পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০-এ প্রতিকার চাইতে হলে সুরক্ষা এবং ক্ষতিপূরণ উভয়ের জন্যই বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আবেদন করতে হবে। শুনানির ওপর ভিত্তি করে আদালত পারিবারিক সুরক্ষা এবং ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন এই আইন অনুযায়ী। আদালতের সুরক্ষা আদেশ লঙ্ঘন করলে সংক্ষুব্ধ নারী আদালতে এই আইনের ৩০ ধারায় পৃথক আবেদন করতে পারেন। আদালত সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে সুরক্ষা আদেশ লঙ্ঘনকারীদের ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দিতে পারে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।