যে বাবার অনুপ্রেরণায় তিনি আজ মাইক্রোসফটের সিইও

জন্মসূত্রে নাদেলা ভারতীয়। তাঁর বাবা বি এন ইয়ুগান্ধার ছিলেন ভারতের উচ্চপদস্থ একজন সরকারি কর্মকর্তা...

বাবার সঙ্গে সত্য নাদেলা
ছবি: লিংকডইন

মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সত্য নাদেলা ১৬ জুন নতুন পদে যোগ দিলেন। তিনি এখন এই বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। জন্মসূত্রে নাদেলা ভারতীয়। তাঁর বাবা বি এন ইয়ুগান্ধার ছিলেন ভারতের উচ্চপদস্থ একজন সরকারি কর্মকর্তা। দায়িত্ব পালন করেছেন ন্যাশনাল একাডেমি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে। গত বছর বাবা দিবসে সত্য নাদেলা লিংকডইনে একটি ব্লগ লেখেন। তাতে উঠে আসে বাবার কাজ, জীবন ও তাঁর থেকে পাওয়া শিক্ষার কথা।

বাবাকে নিয়ে আমার ছেলেবেলার প্রথম স্মৃতি হলো, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বিছানার পাশে তাঁকে বই পড়তে দেখা। চারদিক নিশ্চুপ, অন্ধকার। শুধু জ্বলত বিছানার পাশের বাতিটা। বাবার সাদা পাঞ্জাবিতে পড়ত সেই আলোর ছটা। আমার চোখে এখনো ভাসে, মশারির ভেতর বসে সাদা পাঞ্জাবি পরা বাবা বই পড়ছেন। আমাদের বিছানার পাশে তাঁর অফিসের কাগজপত্র স্তূপ হয়ে থাকত।

শুধু চাকরি নয়

কাজের জন্য ভারতের প্রত্যন্ত সব অঞ্চলে যেতে হতো তাঁকে। সেসব জায়গার নানা রকম ঝুটঝামেলার সমাধান করে গভীর রাতে বাড়ি ফিরতেন। তাই কাগজপত্রগুলো কোনোরকমে বিছানার পাশে রেখে, স্নান সেরে, পোশাক বদলে আবার কাজে বসে পড়তেন। আমরা খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম, তিনি কাজ করতেই থাকতেন। মাঝরাতে যখন তাঁর কাজ শেষ হতো, তখন ঘুমানোর আগে ঘণ্টাখানেক প্রিয় রুশ লেখকের বই পড়তেন। ওটাই ছিল তাঁর বিশ্রাম, নিজের জন্য একান্ত কিছু মুহূর্ত। ওই মুহূর্ত, ওই স্মৃতিটাই আমার বাবার নিষ্ঠা, একাগ্রতা, পরিশ্রম আর মূল্যবোধের প্রতিচ্ছবি হয়ে চোখে লেগে আছে।

সত্য নাদেলা
মাইক্রোসফট

বাবার কাজটা তাঁর কাছে নিছক চাকরি ছিল না, ছিল তার চেয়েও বড় কিছু। ভারত যখন স্বাধীন হয়, তখন তাঁর বয়স ১০ বছর। এর এক যুগ পর সরকারি চাকুরে হিসেবে তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে (আইএস) যোগ দেন। তাঁর কাছে এই চাকরিটা হয়ে ওঠে জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। ওই সময় ভারতের বাতাসে উড়ছিল নতুন একটা দেশ গড়ে তোলার উদ্দীপনা, আর আমার বাবা বুকভরে সেই বাতাসকে নিজের ফুসফুসে, মনে, মননে ভরে নেমে পড়েন দেশ গড়ার কাজে।

বাবার প্রভাব

ভূমি উন্নয়ন, দাসপ্রথা, পানিসংকট, বর্ণবৈষম্য রোধ—এসব বাবার কাছে কোনো গড়পড়তা সমস্যা ছিল না। এগুলোর নিরসন হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। বছরের পর বছর তিনি নিরলসভাবে মাঠপর্যায়ে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন আইন প্রণয়নে, সেই আইন প্রয়োগে। কোনো বুলি আওড়ানো প্রশংসায় কখনো তাঁকে তৃপ্ত হতে দেখিনি। তিনি স্বস্তি পেতেন তাঁদের আনন্দ দেখে, যাঁদের জন্য তিনি কাজ করতেন, যাঁদের জীবনমান উন্নত করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যেতেন। তিনি যেভাবে নিজের কাজ আর প্যাশনকে এক সুতোয় গেঁথে জীবনে এগিয়ে গেছেন, সেই একই তাড়না আমার ব্যক্তি আর কর্মজীবনকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে।

মা ও বাবার সঙ্গে সত্য নাদেলা, ১৯৭০ সালে তোলা ছবি
ছবি: লিংকডইন

বাবা একজন সফল সংগঠক ছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির গুরুত্ব আমরা তখনই অনুভব করতে পারি, তখনই তাকে মূল্যায়ন করতে পারি, যখন সেই ব্যক্তি ওই দায়িত্ব থেকে সরে নতুন কিছু করতে যায়। তুমি তোমার অনুজদের কীভাবে তৈরি করে গেলে এবং তাদের কতটা স্বাবলম্বী করতে পারলে, তোমার সফলতা তাতেই প্রকাশ পাবে।

তরুণদের প্রতি আস্থা

সংগঠক হিসেবে বাবা খুব ক্লান্ত বোধ করতেন, যখন দেখতেন কেউ নিজের দায়িত্ব আর সক্ষমতা না বুঝেই বড় বড় সংস্কার আর দিন বদলের কথা বলে। তাঁর মতে, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সক্ষমতা বাড়ালেই এর ইতিবাচক প্রভাব সমাজে পড়বে। তিনি তাঁর জীবনের বড় একটা অংশ কাটিয়েছেন ভারতের ন্যাশনাল একাডেমি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে। প্রথমে তিনি ছিলেন সেখানকার ছাত্র, এরপর জুনিয়র ফ্যাকাল্টি হিসেবে কাজ করেন, পরে সেখানকার পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

তাঁর প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে নিয়ে ভীষণ গর্ব করতেন বাবা। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, যে তরুণেরা সমাজ বদলের প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিজেকে দেশের কাজে নিয়োজিত করে, তারাই পারে অবহেলিত মানুষ আর অঞ্চলের চিত্র বদলে দিতে। তরুণদের নিয়ে বাবার সব সময় ভীষণ আস্থা ছিল।

যে শিক্ষা পথ দেখিয়েছে

বাবা যে কথাটা আজীবন শিখিয়ে গেছেন সেটা হলো, মনকে খোলা রাখো, চিন্তাভাবনায় উদার হও আর কৌতূহলকে আমৃত্যু জিইয়ে রাখো। বাবা বলতেন, ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে—রক্ষণশীল চিন্তা আর গোঁড়া মতবাদ একটা সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে। তাই অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও আজীবন তিনি নিজেকে স্বচ্ছ আর উদার রেখে একজন সরকারি চাকরিজীবীর দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

আমার বাবা বি এন ইয়ুগান্ধার (বন্ধু আর নাতি-নাতনিদের কাছে ইয়ুগি) গত বছর (২০১৯) মারা যান। কয়েক বছর ধরে বার্ধক্যের নানা রোগের সঙ্গে তাঁকে লড়তে হয়েছে। তিনি আমাকে বলতেন, ‘প্রতিটি দিনেই আমরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাই। কিন্তু মৃত্যুর পরও আমরা বেঁচে থাকতে পারি অন্যকে বাঁচতে শেখানোর মধ্য দিয়ে, মানবিক হওয়ার মধ্য দিয়ে।’ আমার জীবন আর পেশা আমার বাবার থেকে একেবারেই আলাদা। তাঁর সময় থেকে বর্তমানের বাস্তবতাও পুরোপুরি ভিন্ন। এরপরও তাঁর থেকে পাওয়া শিক্ষা এখনো আমাকে পথ দেখায়, এখনো তাঁর মূল্যবোধ, তাঁর জীবনদর্শন আমার অনুপ্রেরণা।

ইংরেজি থেকে অনুদিত