
‘রং’ একটি শব্দ। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা জানতে না পারছি কী রং, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কল্পনায় সে ধরা দিচ্ছে না। যখনই জানতে পারছি ‘সবুজ রং’ তখনই কল্পনায় ভেসে উঠছে সবুজ রঙের অনেক রূপ, অনেক চেহারা। তা শুধু হালকা সবুজ বা গাঢ় সবুজ বলে বর্ণনা করা যাবে না, সম্ভবও না। ওই রংটি প্রকৃতিতে কোন জিনিসে অবস্থান করছে সে জিনিসটির নাম ধরে বলতে হবে। যেমন পেয়ারা পাতার মতো সবুজ অথবা বাঁধাকপির খেতের মতো নীলচে সবুজ। এখানে কিন্তু পেয়ারা পাতার সবুজ অথবা বাঁধাকপির সবুজ সম্পূর্ণই আলাদা, কচি ধানের খেতের সবুজের চেয়েও।
প্রকৃতির দিকে তাকালেই দেখতে পাই কোটি কোটি রং। বারবার তাকাই প্রকৃতির দিকে। চোখ, মন ও মগজ ভরে নেই নানা রঙে। রংপাগল মানুষ আমি। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতাম প্রতিটি শিশু যেমন আঁকে। মা যখন ভাত খাওয়াত লালশাক মেখে, চোখ ফেরাতে পারতাম না। অথবা অবাক হয়ে দেখতাম গলদা চিংড়ির নীলচে ঠ্যাং রান্নার পরে কেমন উজ্জ্বল কমলা রং হয়ে যায়।
বড় হয়ে আঁকার আগ্রহ থেকেই ভর্তি হই চারুকলার অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগে। জলরঙে ল্যান্ডস্কেপ স্টাডি করতে গিয়েই আমি ভাসতে লাগলাম রঙের সমুদ্রে। আজও ভাসছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই আমি এক-আধটু পোশাকের ডিজাইন করতাম। পরে তা নেশায় পরিণত হয়। এবং তারও পরে এটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিই। পাগলের মতো খুঁজে বেড়াতাম প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ। একটা ফুল, একটা প্রজাপতি, কিছু শুঁয়োপোকা, পাতার গায়ের ছত্রাকের রং প্রভৃতি থেকে চুরি করতে থাকলাম রং। মানে কম্বিনেশন, যা আমি আমার নকশা করা পোশাকে ব্যবহার করতে থাকলাম।
প্রকৃতি হয়ে উঠল আমার শিক্ষক। সহজ হয়ে উঠল আমার কাজ। একটা ফাটানো তেলা কুঁচ ফল হাতে নিলেই মনে হতো এর খোসার সবুজটি হবে শাড়ির পাড় আর ভেতরের লালচে কমলাটা হবে জমিন। তেমনই চষা জমির রং আমার কাছে হয়ে উঠল শাড়ির জমিন আর দিগন্তের সবুজ ও ফিকে সবুজ লাইন হয়ে উঠল শাড়ির পাড়। এভাবেই চলতে থাকে আমার পোশাক তৈরির কারখানা।

পোশাক মানুষকে বাহ্যিকভাবে সুন্দর করে তোলে। পোশাকের রংটি-ই সবার আগে মানুষের নজর কাড়ে। তারপর নকশা ও প্যাটার্ন। আমি মনে করি না যে খুব রংচঙে পোশাকই একটি মানুষকে সুন্দর করে তুলতে পারে। বরং বেশি এবং বেহিসাবি রঙের ব্যবহার আমাদের দৃষ্টিকে ক্লান্ত করে। অতিমাত্রায় উজ্জ্বল রঙের পোশাকের আড়ালে ঢাকা পড়ে যেতে পারে মানুষটি। একটি ভালো পোশাক তৈরি করতে হলে প্রয়োজন রঙের সংযমী ব্যবহার। দীর্ঘদিন প্রকৃতি থেকে পোশাকের রঙের কম্বিনেশন চুরি করে করে আমি একটি জিনিস খুব ভালোভাবে বুঝতে শিখেছি-প্রকৃতিতে কোথাও কোনো বেহিসাবি রঙের ব্যবহার নেই। কুটুম পাখির হলুদ আর কালোর দিকে তাকালে মনে হয় এই হলুদটাই দরকার। একদম নিখুঁত। আবার মাছরাঙার ঠিক ওই রংগুলো দিয়েই যদি পোশাক ডিজাইন করা হয়, তাহলে হয়ে উঠবে একটি নজরকাড়া চমৎকার পোশাক।
কুটুম পাখি আর মাছরাঙা দেখতে দেখতে একদিন চোখ পড়ল হিজল ফুলে। চোখে ভেসে উঠল শাড়ির ডিজাইন। মন গুনগুন করে গেয়ে উঠল ‘হিজল ফুলে যে রংটি আছে, সেই রংটি আছে শাড়ির কাছে... ’। ঝুমকো লতার ফুল দেখে মন আমার লাফিয়ে উঠল ‘দুলছে লতায় ঝুমকো লতার ফুল, শাড়ির রঙে হয়নি কোনো ভুল।’ বৈশাখে ফোটে কৃষ্ণচূড়া। কালবৈশাখীর পরে রাস্তার পিচ ভিজে কালচে হয়ে ওঠে। সেই ভেজা পিচের ওপর পড়ে থাকে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি। আর সেই রঙের বিন্যাসেই তৈরি হয় তাঁতের শাড়ি। ‘শহুরে পিচের রাস্তাজুড়ে কৃষ্ণচূড়া থাকে পড়ে। পাও কি তারে খুঁজে? শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে।’
এভাবেই প্রতিনিয়ত চলছে আমার প্রকৃতি থেকে পোশাকে রং কুড়োনোর খেলা, আর চলবেও আজীবন।