রং হারানো বিবর্ণ এক জীবন (ছয়)

(পূর্ব প্রকাশের পর)
জীবনের এই সীমান্তে দাঁড়িয়ে দিন-রাত একটি ভাবনাই আমাকে গিলে খাচ্ছে। আমার জন্মটা আসলে কীসের জন্য। কী এমন ক্ষতি হতো একটি মানুষ পৃথিবীতে না জন্মালে। সৃষ্টির সেরা হয়ে জন্ম নিয়ে কী এমন বিশ্বজয়ের স্বাদ পেলাম। আমার জন্ম হলো নতুন হিসাবের খাতা খোলার মতো। এমন কেউ তো আর সৃষ্টিকর্তার কাছে নিবেদিত ছিল না যে আমাকে পৃথিবীতে আনতেই হবে।
জন্ম মানেই সময় আর সংসারের কঠিন ফাঁদে আটকে যাওয়া। সংসারের কোনো কোনো রীতি থাকে, যা আড়াল হয় না কখনোই। আর সেসব রীতির ফাঁকফোকরই বা ঠিকঠাক বুঝে নিতে পারে কজন। শেষে বিড়ম্বিত জীবনের সঙ্গে বসবাস ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না মানুষের। তাই সময়টাকেও মনে হয় নিষ্ঠুর আর অবিবেচক।
সংসারের প্রয়োজনেই যৌবন হারিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছিল আমার। একটি সমস্যা শেষ হতে না-হতেই অন্যটি মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াত ডাকসাইটে ভাব ধরে। বুঝে নিলান, সমস্যা মানেই জীবন। জীবনে পথে এর রফা নেই। চিরদিনের মতো চোখ বন্ধ হলেই সব শেষ।
সন্তান দুটি যখন ছোট ছিল তখন ভাবতাম, নিজের জীবন তো গেলই ওদের লেখাপাড়া শিখিয়ে মানুষ করে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু সেই আশাটুকুও যে এভাবে পুড়ে ছাই হবে, তা ভাবতে পারিনি কখনোই। নিজের মনের ভেতর একটি ছাড় ছিল তখন, ওরা বড় হলে আমাকে বুঝবে পারবে। কিন্তু নিজেই বুঝতে পারিনি, বোঝার মতো বয়সও তো ওদের হতে হবে। তার আগেই যে দুষ্টচক্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে পারে ওরা।
কোনো রকমে স্কুল পাস দিতে পেরেছিল বড় ছেলেটা। তারপর আর বই নিয়ে বসেনি সে। একদিন আমার স্ত্রী ডুকরে কেঁদে উঠে বলেছিল, মেয়েমানুষ হয়ে আমি একাই-বা আর কী করতে পারি। গোটা দিনটাই তো বাইরে কাটায় ছেলেরা। কোথায় যায়, কী করে, জানি না। আমি কি আর ওদের পিছু নিতে পারি। নিজে তো বিদেশে গিয়ে বসে আছ। এই সংসারে খেটেখুটেই তো জীবন কয়লা হলো। তবুও সারা দিন শুধু আমাকেই দুষবে!
বুঝলাম, কথা সত্য। কারও কোনো দোষ নেই। সব দোষই আমার। বাবা কাছে থাকার পরও তো সন্তান মানুষ হয় না। মায়ের কথা ছেলেরা কতটুকুই বা শোনে। একদিন বিশাল আশা নিয়েই প্রবাসে এসেছিলাম। কিন্তু জীবনে এই সন্ধ্যাকূলে দাঁড়িয়ে আজ মনে হচ্ছে, প্রবাসজীবনের মতো অভিশাপ মানুষের জীবনে আর হতে পারে না কিছুই।
জীবনের প্রায় সবটায় উবে গেল কাজ আর কাজের পিছু নিয়ে। এখন শরীরের বাঁধন আলগা হয়ে একেবারে নড়বড়ে। তবুও তো কাজে যেতে হয়। প্রায় প্রতিদিনই ওষুধ লাগে। রাতে চোখে পানি আসে স্ত্রীর কথা ভেবে। তার জন্যও তো কিছু করা গেল না। কী পেল সে। না পেল টাকা, না স্বামীর সোহাগ। মেয়েরা তো শুধু দুবেলা খেতেই স্বামীর ঘরে আসে না।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছি এখন। শেষ বিকেলের সূর্যটির দিকে তাকিয়ে আবার ভাবতে হচ্ছে আমাকে, বাকি জীবনই-বা কী করে চলবে আমার! এই যে রুক্ষতা, তা কি আর বলে বোঝানো যাবে। যদি কেউ জীবন দিয়ে উপলব্ধি না করে।
আমার হাতে কিছুই তো আর গচ্ছিত নেই। এই নড়বড়ে শরীর নিয়ে নির্মাণ সাইডে কাজ করা খুবই কঠিন। তবুও তো যেতে হচ্ছে। যাচ্ছি আর ঘরে ফিরে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জীবনের মানে খুঁজে চলেছি। এটা কোনো জীবন নয়। একে মানুষের জীবন বলা চলে না। তাহলে এটা কী! তার বিন্দুবিসর্গও খুঁজে পাই না।
শেষে ঠিক করলাম, বড় ছেলেটাকে বিদেশে এনেই দেশে ফিরব আমি। একদিন কিন্তু এর ঠিক উল্টোটা ভেবেছিলাম। কোনো দিনই ছেলেকে বিদেশে নিয়ে আসব না। প্রয়োজনে দেশের মাটিতে থেকে পান-বিড়ির দোকান করবে। তাও অনেক ভালো। কিন্তু মত বদলাতে সময় যেন বাধ্য করল আমাকে। অনিবার্য হয়ে উঠেছিল ছেলেকে বিদেশে নিয়ে আসা। কারণ, অল্পবিস্তর নেশা করে নাকি বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে ছেলেটা। ওর জীবনও যে আমারই মতো হবে, তা আর বুঝতে বাকি রইল না।
যে কথা বলা হয়নি কোনোদিন, আজ তাই-ই জুড়ে দিতে ইচ্ছে করছে সবার বুকের ভেতর। প্রবাসজীবনের সেই প্রথম থেকেই নিজের কথা ভাবিনি কখনো। মনে হতো আমি একা কষ্ট করে যদি বাড়ির সবাইকে ভালো রাখা যায়, সেটাই আমার সুখ। আজ প্রশ্ন জাগে মনে। তারাও কি ভালো থাকতে পেরেছে! কিছুই হলো না। অনর্থকই নিজের জীবনটা মিথ্যে করে দিলাম।
আপ্রাণ চেষ্টা করে যেতাম সন্তানের চাওয়াটা পূরণ করতে। আমি তো আর ওদের কাছে থাকি না। বাবার আদরও তো ওদের দরকার। নিজেকে বড় ব্যর্থ বলে মনে হয় আজ। বিড়ম্বনা যে জীবনটকে এত নিগূঢ়ভাবে জাপটে ধরবে তা বুঝতে পারিনি। বোঝা যায় না অনেক কিছুই। যখন বোঝা যায়, তখন আর সময় থাকে না। শুধু মাথা নুইয়ে পুরোনো স্মৃতিগুলো ঘেঁটেঘুঁটে হিসাব কষে মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার লাভ-ক্ষতি। কী পেলাম আর কী হারালাম। এর মধ্যেই হয়তো বাঁধা থাকে জীবন। (শেষ)
কাজী সাইফুল ইসলাম
রিয়াদ, সৌদি আরব