রঙে রঙে প্রতিবাদ

বিভিন্ন সময় নারীরা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বেগুনি, গোলাপি, কমলা ইত্যাদি রং। মডেল: আনসা, উর্বি ও নীলাঞ্জনা, পোশাক: যাত্রা/যাত্রা মেলা, সাজ: পারসোনাছবি: কবির হোসেন

কখনো কখনো বিশেষ একটি রংই হয়ে উঠতে পারে প্রতিবাদের প্রতীক। হতে পারে তা কালো, সাদা, গোলাপি কিংবা অন্য কোনো রং। এই যেমন ২০১৮ সালে কালো পোশাক পরে গোল্ডেন গ্লোবের লালগালিচায় হেঁটে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন হলিউডের অভিনেত্রীরা। আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন সময় নারীদের নিয়ে যে কটূক্তি করেছেন, তার প্রতিবাদে ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গোলাপি রঙের টুপি পরে মহাসমাবেশ করেন নারীরা। এভাবে একেকটা রং হয়ে ওঠে নির্দিষ্ট কোনো ইস্যুর ভাষা।

একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্‌ কবির মনে করেন, ‘রং প্রতীক হিসেবে কাজ করে। কোনো সমস্যা সমাধান করার জন্য যে রং বেছে নিচ্ছি, তা কিন্তু নয়। গান দিয়ে যেমন মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো যায়, তেমনি রঙের মাধ্যমেও মানুষকে সচেতন করা যায়। তবে মনমানসিকতার পরিবর্তন না হলে অবশ্য শুধু রং দিয়ে কিছু হবে না। অনেকে নারী দিবসের নির্ধারিত রং নিয়েও তির্যক মন্তব্য করবেন। দিন শেষে কতটুকু মনমানসিকতা পরিবর্তনের জন্য তাঁরা উৎসুক বা এগিয়ে আসছেন, সেটাও দেখতে হবে।’

নারী দিবসে রঙের পোশাকের মাধ্যমে একাত্মতা প্রকাশ পায়
ছবি: কবির হোসেন

ফ্যাশন ডিজাইনার হুমায়রা খান মনে করেন, ‘রঙের একটা অর্থ আছে। কথা না বলেও রঙের মাধ্যমে একাত্মতা প্রকাশ করা যায়। এর মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া যায় আমরা সবাই একমত, একদলে আছি। আজ পর্যন্ত নারীদের আন্দোলনগুলোতে নিজেদের মতের সঙ্গে একমত পোষণ করতেই একটি রং বেছে নেওয়া হয়েছে। গত কয়েক বছর নারী দিবসে বেগুনি রঙের পোশাক পরার মধ্য দিয়েও নারীদের এ একাত্মতা প্রকাশ পেয়েছে।

বিশ্ব নারী দিবসে এ বছরের রং সবুজ। পোশাক: অরণ্য
ছবি: কবির হোসেন

বেগুনি আন্তর্জাতিকভাবে নারী দিবসের প্রতীকী রং। নারী দিবসের প্রধান রংই বেগুনি। বেগুনি রঙের পোশাকে, সাজে নারীর শক্তি, অধিকার, নারীর উদ্‌যাপনকেই তুলে ধরা হয়। ফারাহ্‌ কবির জানালেন, ‘এ বছর নারী দিবসে সবুজ রংকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সবুজ রঙের মাধ্যমে জলবায়ুর সমস্যা সমাধানে নারীদের সমান অধিকারের বার্তা প্রকাশ করা হবে।’ ১৯০৮ সালে যুক্তরাজ্যের উইমেনস সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইউনিয়ন নারীর সমতার প্রতীক হিসেবে বেগুনি, সবুজ এবং সাদা রঙের একটা সংমিশ্রণ তৈরি করে। যেখানে বেগুনি ন্যায়বিচার এবং মর্যাদাকে বোঝায়। সবুজ আশার প্রতীক। আর সাদা বিশুদ্ধতার প্রতিনিধিত্ব করে। পরে অবশ্য ‘বিশুদ্ধতা’ মানেই সাদা, এ ধারণা নিয়ে বিতর্ক ওঠে।

নারীরা তাঁদের অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন সময় বেছে নিয়েছেন বিভিন্ন রং। ‘নতুন ভোর’ বোঝাতে হলুদ রং। একইভাবে সবুজ আর বেগুনি ঐতিহ্যগত নারীবাদের প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যদিকে হলুদের সঙ্গে বেগুনি প্রগতিশীল নারীবাদের প্রতিনিধিত্ব করে। সাদাকে অনেকেই নারীদের ভোটাধিকারের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। যুক্তরাজ্যের ইতিহাসেও সাদা ছিল মার্কিন ভোটাধিকার আন্দোলনের একটি আনুষ্ঠানিক রং। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন একটি প্রধান রাজনৈতিক দল থেকে প্রথম নারী প্রার্থী হিসেবে যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাঁর সমর্থকেরা তখন সাদা প্যান্ট–স্যুটে তৃতীয় এবং চূড়ান্ত রাষ্ট্রপতি বিতর্কে উপস্থিত হন। পরে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে #ওয়্যারহোয়াইটটুভোট নামের একটি আন্দোলনই শুরু হয়ে যায়। ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশনের শেষ রাতেও সাদা পোশাক পরেছিলেন হিলারি ক্লিনটন।

কমলা রংও এখন প্রতিবাদের রং
ছবি: কবির হোসেন

আবার পাশ্চাত্যে প্রায় এক শতাব্দী ধরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে গোলাপি রং। এ ক্ষেত্রে গোলাপির প্রথম ব্যবহার দেখা যায় ১৯২৫ সালে। এর বাইরে ৩০ বছর ধরে স্তন ক্যানস্যার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতেও ব্যবহৃত হচ্ছে এ রং। কমলা রংও শক্তিশালী প্রতীক। ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনের প্রচারণা চালায় জাতিসংঘ। ২৫ নভেম্বর নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নির্মূলের আন্তর্জাতিক দিবস থেকে ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত কমলা রঙের পোশাক পরে চলে প্রচারণা।

বৈশ্বিক রং নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান প্যানটোন এ বছরের বৈশ্বিক রং হিসেবে বেছে নিয়েছে ভেরি পেরি। এ রাজকীয় রং উজ্জ্বল আলোতে দেখায় বেগুনি আর ম্লান বদ্ধ জায়গায় গভীর নীল। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, ভেরি পেরি ২০২২ সালে আমাদের আশা জাগাবে এবং এগিয়ে যেতে জোগাবে সাহস। এ রঙের ভাবনাটাই যেন ঠিক এ বছরের নারী দিবসের বার্তার সহায়ক, যা সর্বক্ষেত্রে নারীদের সাহস, সৃজনশীলতা এবং কল্পনাপ্রবণ অভিব্যক্তিকে উৎসাহিত করবে।

বিভিন্ন সময় গোলাপি ও বেগুনি রং হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা
ছবি: কবির হোসেন

নারী দিবসে নির্ধারিত রঙের পোশাক বা অনুষঙ্গ পরার মধ্যে নারীদের অর্জনকে উদ্‌যাপন করার মধ্যে কোনো নেতিবাচক বিষয় নেই। হ্যাঁ প্রতিটি দিনই নারীর, ঘরের ভেতরে–বাইরে, পুরো বিশ্বেই তাঁদের কাজের জায়গা ছড়িয়ে আছে। নারীর অর্জনও অগণিত। একই রঙের পোশাক পরে ৮ মার্চ উদ্‌যাপনের পাশাপাশি আমরা সবার কাছে নারী দিবসের বার্তাও পৌঁছে দিতে পারি।