রাজউক যেভাবে সেরা

রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ সারা দেশের মধ্যে টানা চতুর্থবারের মতো প্রথম! বিষয়টা আর সবাইকে অবাক করলেও অবাক হন না কলেজটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ফল প্রকাশের পরদিন কলেজে হাজির হলে অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমামুল হুদা এক টুকরো হাসি দিয়ে যেমনটি বললেন, ‘আমাদের কলেজ যে চার বছর ধরে সারা দেশের মধ্যে প্রথম হচ্ছে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মূল বিষয় হচ্ছে, টিমওয়ার্ক। আমরা ছাত্র-শিক্ষক এবং অভিভাবক মিলে একটা টিমের মতো কাজ করি। যার ফলে আমরা শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ধরে রাখতে পেরেছি।’
ব্যাপার তাহলে এতটুকুই! প্রতিবছর এইচএসসির ফল প্রকাশিত হবে আর ‘সেরাদের সেরা’ বলে খবরের শিরোনাম হবে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ—প্রায় নিয়মে পরিণত হওয়া এই বিষয়ের পেছনে আর কোনো রহস্য-টহস্য নেই? নেই কোনো জাদুমন্ত্র! এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা আসলে কী বলেন?
‘সত্যি কথা বলতে কি, এই যে আমি জিপিএ ৫ পেলাম, তার পেছনে একমাত্র অবদান আমার কলেজের। কলেজের নিয়মশৃঙ্খলা আর পড়াশোনার পদ্ধতির কারণে আমার জিপিএ ৫ নিশ্চিত হয়েছে।’ বলছিলেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পাওয়া আল আবির হোসেন।
কী ধরনের নিয়মশৃঙ্খলা? কেমন পড়ালেখার পদ্ধতি? ব্যাপারটার কিছুটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল আরেক জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থী নুসরাত জাহানের কাছে। ‘আমাদের প্রতিটা ক্লাস হয় ৪৫ মিনিটের। কোনো বিষয় না বুঝলে শিক্ষকেরা সেটা একাধিকবার বুঝিয়ে দেন। ফলে ক্লাসের পড়া আমাদের ক্লাসেই হয়ে যায়। এ জন্য কোনো কোচিং বা প্রাইভেট টিউটরের প্রয়োজন পড়ে না।’
নুসরাতের সঙ্গে যোগ করেন হাসিন আবরার, যিনিও জিপিএ ৫ পেয়েছেন, ‘রাজউকে ভর্তি হয়ে পড়ালেখায় ফাঁকি দেওয়ার আসলে কোনো সুযোগ নেই। কারণ, এক দিন ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলেই সঙ্গে সঙ্গে এসএমএস চলে যায় মা-বাবার ফোনে। ক্লাস টেস্ট থেকে শুরু করে ছোটখাটো সব পরীক্ষার ফল জানানো হয় অভিভাবকদের। তাই পড়াশোনাটা করতেই হয়।’
তাঁদের আরেক বন্ধু মুনতাহিনা বিনতে লতিফ বলেন, ‘পড়াশোনার ব্যাপারে এত কড়াকড়ির পরেও আমরা হাঁপিয়ে উঠি না। কারণ, আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের পাঠ্যবই পড়ার ব্যাপারে যেমন তাগাদা দেন, তেমনি সৃজনশীলতার চর্চা করতেও উৎসাহিত করেন। তাই আমাদের কলেজে নিয়মিত সাংস্কৃতিক সপ্তাহ, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান মেলা, আন্তকলেজ ক্রিকেট, ফুটবলসহ সব ধরনের খেলাধুলা অনুষ্ঠিত হয়।
মুনতাহিনার কথার পেছনে যোগ করেন সুমাইয়া আশরাফ, ‘শুধু তা-ই নয়, পড়াশোনা যেন আমাদের মনের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে সে জন্য নিয়মিত মোটিভেশনাল ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়। এই ক্লাসে পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভিডিওচিত্র দেখানো হয়। আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে এমন চলচ্চিত্র দেখানো হয়। আর পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকদের জীবনী ও লেখা পড়তে দেওয়া হয়।’
একটু গলা খাঁকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নাভির আনজুম, ‘এখানে আমি একটু যোগ করতে চাই। আমরা যারা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী, তাদের পাঠ্যবইয়ের তত্ত্বীয় বিষয়ের প্রায়োগিক জ্ঞান লাভ করতে হয় ল্যাবরেটরিতে। সেই প্রয়োজন মেটাতে আমাদের একটি আধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ ল্যাবরেটরি রয়েছে। আর আছে প্রয়োজনমাফিক একাধিক বই ব্যবহার করার জন্য সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার।’
এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন মিনহাজুর রহমান। এবার তিনি কিছু বলতে চান। ‘আমাদের শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার আর ল্যাবরেটরিতে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা। আমাদের শিক্ষকেরা ক্লাস নেন মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে। কম্পিউটার ল্যাবে আমরা শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারি।’
বোঝা গেল, উপযুক্ত পরিবেশ, শৃঙ্খলিত জীবনাচরণ, আনন্দময় পাঠাভ্যাস ও নিয়মানুবর্তিতা—এই সবকিছু রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের ললাটে সেঁটে দিয়েছে ‘সেরাদের সেরা’ তকমা। এ বছর এই কলেজ থেকে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন মোট এক হাজার ২৬২ জন। তার মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছেন এক হাজার ২০১ জন।
কলেজ ঘুরে আরও জানা গেল, এখানে ক্লাস হয় দুই শিফটে—মর্নিং শিফট ও ডে শিফটে। আছে সীমিতসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক ব্যবস্থা এবং অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহনব্যবস্থার সুযোগ।