রাজপ্রাসাদের চেয়ে ভালোবাসা বড়

‘ভাবটা এমন যেন রাজপুত্র’, ‘কোন রাজ্যের রাজকন্যা তুমি?’—টিটকারি করে বলা এমন কথা আমরা প্রায়ই শুনি। রাজপুত্র, রাজকন্যা শব্দগুলো শুনলেই আমাদের চোখের সামনে এমন কিছু ভেসে আসে, যেখান থেকে কেবল ‘সুখ আর সুখ’ এমন বার্তা আসে। তবে এই গল্পগুলো জানা থাকলে সেই ভুল ভাঙতে সময় লাগবে না। অসংখ্য রাজকুমার ও রাজকুমারী ভালোবাসার জন্য ছেড়েছেন রাজ্য, রাজপ্রাসাদ, পদবি আর উত্তরাধিকার। তাঁদের কাছে রাজপ্রাসাদের চেয়ে ভালোবাসা বড়। আর ভালোবাসার চেয়ে বড় কিছু নেই। কেননা, সেই ভালোবাসার পরশেই তাঁরা সবচেয়ে সুখী হন।

সম্প্রতি জাপানের রাজকুমারী মাকো আবারও দিলেন তেমনই এক বার্তা। এই রাজকুমারী জানালেন, তাঁর স্বপ্নের ‘রাজকুমার’ একজন সাধারণ মানুষ। রাজকীয় মর্যাদা ত্যাগ করে কলেজজীবনের ভালোবাসার মানুষ কোমুরোকে বিয়ে করেছেন। জাপানে রাজকীয় বিয়ের ক্ষেত্রে যেসব আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করা হয়, সেগুলোও পরিহার করেছেন মাকো। মাকোর রাজপদবি হারানোর পর ঐতিহ্য অনুযায়ী ১৩ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ১১৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা) পাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি এই পারিবারিক অর্থ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। ফলে জাপানি রাজপরিবারের তিনিই প্রথম ও একমাত্র সদস্য, যিনি পদপদবি-অর্থ ত্যাগসহ পুরোপুরি রাজকীয় সম্পর্ক ছিন্ন করলেন।

মাকো ও কেই কোমুরো দম্পতি থিতু হবেন যুক্তরাষ্ট্রে
ছবি: এএফপি

রাজপরিবার ছেড়ে সাধারণ জীবনযাপন করা সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রিন্স হলেন হ্যারি। তিনি স্ত্রী মেগান মার্কেল আর দুই সন্তান নিয়ে এখন আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তাঁরা রাজপরিবার ছাড়েন। হ্যারি মেগানের দ্বিতীয় স্বামী। এর আগে ২০১১ সালে তিনি বিয়ে করেছিলেন মার্কিন অভিনেতা ও প্রযোজক ট্রেভর অ্যাঙ্গেলসনকে। সাত বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর তাঁদের সেই ঘর টিকেছিল মাত্র তিন বছর। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দুজনের। তিন বছর পর প্রিন্স হ্যারির মন কেড়ে নেন তিনি। ২০১৮ সালের ১৯ মে বিয়ে করেন তাঁরা।  

‘প্রিন্স’ হ্যারি ও মেগান মার্কেলের ডিউক আর ডাচেস পদবি অপরিবর্তিত আছে
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

অবশ্য ব্রিটিশ রাজপরিবারের জন্য এ ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও অষ্টম এডওয়ার্ড ঘটিয়েছিলেন এমন ‘দুর্ঘটনা’। তিনিও বিয়ে করেছিলেন তালাকপ্রাপ্ত ওয়ালিস সিম্পসনকে। তা–ও আবার একবার নয়, দুবার। সেই সময়ে তালাকপ্রাপ্ত মানুষের আদালতে যাওয়ারই অধিকার ছিল না, আর রাজকুমারকে বিয়ে করে ব্রিটিশ রাজপরিবারে প্রবেশ করাটা তো বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার শামিল! এ ঘটনা রীতিমতো তোলপাড় করেছিল রাজপরিবারকে। অমর প্রেমের গল্পে স্থান পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়ে তবেই অষ্টম এডওয়ার্ড বিয়ে করেছিলেন ওয়ালিস সিম্পসনকে।

অষ্টম এডওয়ার্ড ও ওয়ালিস সিম্পসন
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

এডওয়ার্ড ছিলেন সুদর্শন। তাঁর সোনালি চুল, নীল চোখ আর ব্যক্তিত্বের জন্য বিশ্বের সেরা নারীর যোগ্য ছিলেন তিনি। অন্যদিকে ওয়ালিস খুব সুন্দরী না হলেও চেহারায় দীপ্তি ছিল, ছিল আকর্ষণীয় শারীরিক গঠন আর তিনি ছিলেন ফ্যাশনসচেতন। ১৯৩১ সালের ১০ জানুয়ারি এক পার্টিতে ওয়ালিসের সঙ্গে এডওয়ার্ডকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অষ্টম এডওয়ার্ডের তৎকালীন প্রেমিকা লেডি ফারনেস। সেই ভুলেই সব শেষ হয়ে গেল তাঁর! মাত্র ৩২৬ দিনের মাথায় মুকুট ছুড়ে ফেলে সিংহাসন ত্যাগ করে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কম মেয়াদি রাজার তালিকায় নাম লিখিয়েছিলেন অষ্টম এডওয়ার্ড। এরপর তিনি চলে যান ফ্রান্সে, তাঁর প্রেয়সীর কাছে। ১৯৩৭ সালের ৩ জুন এডওয়ার্ড ওয়ালি সিম্পসনকে বিয়ে করে প্যারিসে বসবাস শুরু করেন। তাঁরা কি সুখী হতে পেরেছিলেন? বেঁচে থাকতে ওয়ালিস শুধু একবার বলেছিলেন, কেউ জানে না অমর এক প্রেমকাহিনির মতো জীবন যাপন করা কত কঠিন!

অষ্টম এডওয়ার্ডকে বিয়ের আগে আরও দুটো বিয়ে করেছিলেন ওয়ালিস সিম্পসন
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

ভূমিবল আদুলাদেজকে থাইল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি বললে বাড়াবাড়ি হবে না। এই রাজার প্রতি প্রজাদের ভক্তি ছিল অপরিসীম। বলা হয়, বিশ্বে তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সিংহাসনে থাকা রাজা। ৭০ বছর ধরে রাজার আসনে ছিলেন তিনি। তাঁরই কন্যা উবলরত্ন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) পড়ার সময় মন দেওয়া–নেওয়ার কাজটি সেরে ফেলেন পিটার ল্যাড জেনসেনের সঙ্গে। ১৯৭২ সালে তিনি রাজকুমারী পদবি ফেলে বিয়ে করেন এই সাধারণ পুরুষকে। ১৯৯৮ সালে বিচ্ছেদের পর তিনি থাইল্যান্ড ফিরে আসেন। তবে পদবি ফিরে পাননি।  

১৯৯৮ সালে বিচ্ছেদের পর উবলরত্ন থাইল্যান্ড ফিরে আসেন। তবে পদবি ফিরে পাননি।
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

নরওয়ের রাজা হারাল্ড ভি ও রানি সঞ্জার মেয়ে রাজকুমারী মার্থা লুইস। ডেনমার্কের লেখক আরি বেহনকে ২০০২ সালে বিয়ের পর রাজকুমারী পদবি হারান। যদিও ২০১৭ সালে বিচ্ছেদের পর তা আবার ফিরে পান। ২০১৯ সালে আরি আত্মহত্যা করেন।

মার্থা লুইস ২০০২ সালে আরি বেহনকে বিয়ে করেন
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

আর ২০১৯ সালেই এক ইনস্টাগ্রাম পোস্টে মার্থা জানান, তিনি আর রাজকুমারী উপাধি ব্যবহার করবেন না। কেননা, তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। তিনি পদবি ভাঙিয়ে ব্যবসা করতে চান না। অবশ্য পরে জানা গেছে আসল কারণ। মার্থা লুইস এখন নিজের চেয়ে তিন বছরের ছোট, আরেক লেখক শামান ডুরেক ভেরেটকে বিয়ে করবেন। ৫০ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’ ম্যাগাজিনের সঙ্গে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, শিগগিরই বিয়ে করবেন তাঁরা। তাই আবারও হারাবেন ‘রাজকুমারী’ উপাধি। আত্মহত্যার আগে মার্থার প্রথম স্বামী আরি জানিয়েছিলেন, মার্থা আবারও ভালোবাসা খুঁজে পাওয়ায় তিনি প্রকৃত অর্থেই খুশি! কে জানে খুশির কী মানে...

মার্থা লুইস এখন নিজের চেয়ে তিন বছরের ছোট, আরেক লেখক শামান ডুরেক ভেরেটকে বিয়ে করবেন
ছবি: ইনস্টাগ্রাম