রোগী দেখার সময় বাবাকে অনুকরণের চেষ্টা করি

ডা. মো. আলী আকবরের সঙ্গে মেয়ে ডা. নওসাবাহ্ নূর
ছবি: সুমন ইউসুফ

২০০৪ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকের এক সন্ধ্যা। আমাদের বাসায় বিয়ের আয়োজন চলছে। চাচাতো বোনের বিয়ে, বাসাভরা মানুষ। এর মধ্যে হঠাৎ ল্যান্ডফোনে খবর এল—‘সাবাহ্‌ ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে’। বাসাভরা মানুষ রেখে আমি মায়ের সঙ্গে বের হয়ে গেলাম তালিকায় নিজের নামটা স্বচক্ষে দেখার জন্য। পরে যখন বাসায় ফেরত আসি, বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। বাবাকে সব সময় খুব শক্ত মানুষ হিসেবে দেখেছি। তাই প্রথমে একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু একই সঙ্গে মনে হয়েছিল জীবনটা সার্থক। কারণ, আমার চেয়ে আমার বাবা অনেক বেশি খুশি ছিলেন।

এর কয়েক মাস আগে এইচএসসি পরীক্ষার পর যখন মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, বাবা খুব কড়া করে বলে দিয়েছিলেন, ‘মেডিকেলে পড়লে আমার মেডিকেলেই পড়তে হবে।’ তখন খুব অভিমান হয়েছিল—‘আব্বু এভাবে বলছে কেন?’ কিন্তু পরে বুঝেছি, এই চাপ তখন খুব দরকার ছিল। ভর্তিযুদ্ধে ৪০তম হয়ে বাবা যেখানে পড়েছেন, সেখানেই পড়ার সুযোগ পেলাম। বাবা ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ডিএমসি) কে৩১ ব্যাচ, আর আমি কে৬২।

ডা. মো. আলী আকবরের সঙ্গে মেয়ে ডা. নওসাবাহ্ নূর
ছবি: সুমন ইউসুফ

ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, বাবা রোগীদের নিয়ে খুব ব্যস্ত। আজও সেই ব্যস্ততা কমেনি। কিন্তু পরিবার-পরিজন, পরিচিত যে–কারও বিপদে সবার আগে এগিয়ে যেতেন। তিনি চক্ষু বিশেষজ্ঞ হলেও পরিবারের যেকেউ যেকোনো রোগে আক্রান্ত হলে আগে বাবার পরামর্শ নিতেন। কোথায় কোন ডাক্তার দেখাবেন, কী চিকিৎসা নেবেন...।

আমাদের বাসায় রোগীদের বাগানের আম, খেতের সবজি থেকে শুরু করে পরম যত্নে নিজের হাতে রান্না করা খাবারের আনাগোনা সব সময় লেগেই থাকে। বাবা হলেন সবার আস্থার জায়গা, ভালোবাসার স্থান—বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে আকৃষ্ট করেছে, সব সময় অনুপ্রাণিত করেছে ডাক্তার হওয়ার জন্য।

মেডিকেলে ছাত্রী থাকা অবস্থায় পড়াশোনায় বাবা সব সময় সাহায্য করতেন। ভেবে খুব অবাক লাগত, এত দিন পরও বাবার অ্যানাটমি, ফিজিওলজি কীভাবে এত ভালো মনে আছে। পঞ্চম বর্ষে যখন বাবার বিষয় ‘চোখ’ নিয়ে পড়তে হলো, তখন বাবা পুরো অফথালমোলজি খাবার টেবিলে গল্প করে করে পড়িয়ে দিলেন।

আরেকটি সুন্দর স্মৃতি হলো বাবার সঙ্গে প্রতিবছর ১০ জুলাই ডিএমসির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ‘ডিএমসি ডে’ পালন করতে যাওয়া। দিনটি আমার খুব ভালো লাগত। মনে হতো দুজনের কত গল্প, কত স্মৃতি এ ক্যাম্পাস নিয়ে।

এমবিবিএস পাস করে ডাক্তার হলাম। এরপর আরও বড় বড় পরীক্ষা দিয়েছি। বাবা সব পরীক্ষায় আমার সঙ্গে ছায়ার মতো ছিলেন। পরীক্ষার কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনতেন। যখন নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে যেত, তখন বাবাই আবার টেনে তুলতেন, আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতেন। বাবার আদর্শে বড় হয়ে ওঠা আমি এখনো রোগী দেখার সময় বাবাকে অনুকরণের চেষ্টা করি।

আমার এসএসসি–এইচএসসি পরীক্ষার আগে শুধু বাংলা ও ইংরেজির লেখনী একটু ভালো হওয়ার জন্য রাতের পর রাত জেগে বিভিন্ন বই, উপন্যাস ঘেঁটে ভালো ভালো শব্দ ও বাক্য ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। যেন আমি পরীক্ষা হলে ঢোকার আগে একঝলক দেখে যাই এবং সেসব শব্দ সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে কিছু নম্বর বেশি পাই। ডাক্তারদের হাতের লেখা নিয়ে অনেক দুর্নাম আছে, কিন্তু বাবার হাতের লেখা দেয়ালে টাঙিয়ে রাখার মতো।

এখন বড় হয়ে গিয়েছি। কিন্তু এখনো ভুল করলে বাবা বকা দেন। ডিম, করলা, পাঙাশ মাছ না খেলে রাগ করেন। আমার বাচ্চাদের আমি বকা দিলে উল্টো আমাকে শাসন করেন। আদর করে কাছেও টেনে নেন। পছন্দের খাবার আমাকে ছাড়া খেতে পারেন না। যদিও প্রতি সপ্তাহে দেখা হয়, তাও প্রতিবার বাবার বাসা থেকে ফেরত আসার সময় বলবেন, ‘আজই চলে যাবি? আবার কবে আসবি?’

ছোটবেলায় অনেকে বলত, আমি নাকি দেখতে বাবার মতো। আর মেয়েরা দেখতে বাবার মতো হলে নাকি ভাগ্যবান হয়। দেখতে মিল এখনো আছে কি না জানি না, কিন্তু আমি নিজেকে সত্যি ভাগ্যবান মনে করি। আমার বাবার মতো একজন সৎ, কর্মঠ, নিষ্ঠাবান মানুষকে জীবনে অভিভাবক হিসেবে পেয়েছি।

লেখক: মেডিসিন কনসালট্যান্ট, লাইফ স্প্রিং