শতবর্ষী সিলেট স্টেশন ক্লাব

কাজ আর সংসারের বাইরে ‘একটু দম ফেলার জন্য’ আড্ডাঘরের জনপ্রিয়তা আর পরিচিতি বেড়েই চলেছে। অনেক আড্ডার সূত্রপাত ঘটেছে তাকে কেন্দ্র করে। সে রকমই ১৩৫ বছর বয়সী ঐতিহ্যবাহী এক আড্ডাখানা  ‘সিলেট স্টেশন ক্লাব’। একসময় ইংরেজরা বাঙালিদের এই ক্লাবের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিত না। ক্লাবের দেয়ালে লেখা থাকত, ‘ডগস অ্যান্ড নেটিভস আর নট অ্যালাউড’। আজ জাতীয় চা দিবসে জেনে নেওয়া যাক এই ক্লাবের আদ্যোপান্ত।

সিলেট শহর ঘেঁষেই উপমহাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা–বাগান মালনীছড়ার অবস্থান। কারও মতে, ১৮৫৪ সাল, আবার কারও মতে, ১৮৪৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপরই এখানে আরও কয়েকটি চা–বাগান হয়। এসব বাগানের সুবাদেই তখন ব্রিটিশ চা–করেরা সিলেটে আসতেন। তবে আবাসনের ভালো সুবিধা না থাকায় ভোগান্তিতে পড়তেন তাঁরা। তখনকার সময়ে বাগানের ব্যবস্থাপক এবং সহকারী ব্যবস্থাপকও হতেন ইংরেজ কোনো ব্যক্তি।

ব্রিটিশ চা-করদের থাকার সুব্যবস্থা ছিল। তাঁরা চাকরির সুবাদে সিলেটেই থাকতেন। তাঁদের চিত্তবিনোদনের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘সিলেট স্টেশন ক্লাব’। ১৮৮৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর এই ক্লাব উদ্বোধন করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আভিজাত্যের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। তখন কেবল ব্রিটিশরাই এই ক্লাবের সদস্য হতে পারতেন। তবে ১৯৪৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে ক্লাবের মালিকানায়ও বদল ঘটে। নেতৃত্বে আসে বাঙালিরা। সে ধারাবাহিকতা আজও চলছে।

শুরুটা ইংরেজদের হাতে হলেও সৌন্দর্যবোধ, রুচি, সৃজনশীলতা এবং নান্দনিকতায় সিলেট স্টেশন ক্লাব অতীত ঐতিহ্যকে সঙ্গী করে এগিয়েছে। ছিমছাম আর পরিপাটি ক্লাব হিসেবে এর জুড়ি নেই। একসময়ের পাকা আর টিনশেডের ক্লাব এখন বহুতল ভবনে রূপ নিয়েছে। তবে ক্লাব চত্বর আগের মতোই সবুজ-শ্যামল, মায়াময়। ভেতরে দিনে-রাতে আড্ডা আর হাসি-ঠাট্টায় মত্ত হন সদস্যরা। কেউবা বিলিয়ার্ড, পোকার, টেবিল টেনিস, ক্যারম, দাবা, কার্ড কিংবা অন্য কোনো খেলায় অংশ নিয়ে সময় পার করেন। কোনো কোনো সদস্য আবার ক্লাবের সুস্বাদু খাবারের স্বাদ নিতেও আসেন। বিশেষত নানা পদের ভর্তা-ভাজি, শিমের বিচি দিয়ে বোয়াল ও আইড়সহ দেশি মাছের ঝোল, মাংসের তরকারি, ডাল ও টকের সুনামের কথা সবাই জানে।

অবকাশযাপন কিংবা খেলাধুলায় ব্রিটিশরা যেমন ক্লাবে হাজির হতো, এখনো সেটা চলছে। চায়ের কাপে আর পানীয়র গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ব্রিটিশরা যেমন মজে যেতেন আড্ডা-গল্পে, আজ বাঙালি অফিসারদের ক্ষেত্রেও সে কথা সত্যি। তখনো যেমন ক্লাবের খাবারের স্বাদ ছিল অনন্য, এখনো তেমন।

আশির দশকের একটা বর্ণনা পাওয়া যায় হারুন আল রশিদ দীপুর একটি লেখায়। তখনো তিনি এ ক্লাবের সদস্য হননি। লেখাটি মুদ্রিত হয়েছে আহমেদ নূর সম্পাদিত ‘সিলেট স্টেশন ক্লাব লিমিটেড: ১২৫ বছর পূর্তি স্মারক’ গ্রন্থে। হারুন লিখেছেন, ‘তখন ক্লাব ভবনটি ছিল বাংলো প্যাটার্নের টিনশেডে তৈরি। বিভিন্ন গাছগাছালিতে ছেয়ে থাকা সুনিবিড় স্নিগ্ধ পরিবেশে বাইরের অতিথি কক্ষে আমরা বসতাম। ভেতর থেকে কমলা বা আপেলের জুস আসত আমাদের জন্য। আমাদের কাছে ক্লাবটি তখন এক রহস্যময় ভবন।’

এই ‘রহস্যময় ভবন’ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য জানা যায় প্রখ্যাত সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ারের একটি লেখা থেকে। তাঁর এ লেখাটি ‘সিলেট স্টেশন ক্লাব লিমিটেড: ১২৫ বছর পূর্তি স্মারক’ গ্রন্থে ‘সামাজিক ক্লাব: অতীত ও বর্তমান’ শিরোনামে মুদ্রিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘এখানে (সিলেটের) ইংরেজ প্রশাসনিক, পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তা, চা-কর ও ব্যবসায়ীদের সময় কাটানোর জন্য কোনো বিশেষ উদ্যোগ-আয়োজন ছিল না। দিনভর কাজ করার পর অবসরে চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেই। সামাজিকভাবে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে তারা খুব একটা মিশতেন না। ইচ্ছা করেই দূরত্ব বজায় রাখতেন। তাঁদের সামাজিক বন্ধ্যাত্ব দূর করার লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত তাঁরা একটি ক্লাব গড়ল। সেটিই “সিলেট স্টেশন ক্লাব”।’

হাসান শাহরিয়ার আরও লিখেছেন, অন্যান্য ক্লাবের মতো এই ক্লাবেও স্থানীয় লোকজনকে ঢুকতে দেওয়া হতো না। ফটকে লেখা থাকত ‘ডগস অ্যান্ড নেটিভস আর নট অ্যালাউড’ অর্থাৎ ‘কুকুর ও স্থানীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। তবে ১৯৪০ সাল থেকে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। কয়েকজন স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ‘অতিথি’ হিসেবে ক্লাব ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। তখন হাতে গোনা কয়েকজন বাঙালিকে এই ক্লাবের সদস্য করে নেওয়া হয়েছিল। ইংরেজরা বিদায় নেয় ১৯৪৭ সালে, ভারত বিভক্তির পরপরই। তারপর থেকেই ক্লাবটি উচ্চপদস্থ বাঙালির আড্ডাখানায় পরিণত হয়।
এই ক্লাব কেবল এখানকার সদস্যদের জন্য। নিয়ম মেনে, ফর্ম পূরণ করে, চাঁদা দিয়ে, অন্যান্য সদস্যদের অনাপত্তিক্রমে এই ক্লাবের সদস্য হওয়া যায়। বিদেশি উচ্চবিত্ত, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও এই ক্লাবে প্রবেশাধিকার রাখেন। সদস্যদের আমন্ত্রিত অতিথিরাও ঢুকতে পারেন এই ক্লাবে। ক্লাবের বর্তমান সদস্যসংখ্যা প্রায় ৪০০।

ছবি: আনিস মাহমুদ, সিলেট