
‘চলো, আজ শপিংটা সেরেই আসি।’
সুকন্যার কথায় একটু ভড়কে যাই। মনে যা-ই থাক, বাইরে তা প্রকাশ করি না।
মায়ের কথায় ছেলেমেয়ে দুটো লাফাতে থাকে। খানিক পর দেখি, আমিও ওদের সঙ্গে লাফাচ্ছি। সুকন্যা মুখ টিপে হেসে আমাকে আলতো কনুই মেরে বলে, ‘হয়েছে, বাঁদরের মতো আর লাফাতে হবে না। চলো, বেরিয়ে পড়ি।’
আমার জিম্মায় যত টাকা আছে, সবই মানিব্যাগে নিয়েছি। জানি, দামের পাগলা ঘোড়া যখন লাগাম ছাড়াবে, সুকন্যা তখন ঠিকই চিল্লানি দেবে, ‘আশ্চর্য, টাকা আনোনি!’
পাড়ার বড় গেটটার বাইরে লাঠি ভর করে চেনা ভিখিরিটা দাঁড়িয়ে। মানুষের গতিবিধি তার নখদর্পণে। সে ঠিকই আঁচ করে সপরিবার কোথায় যাচ্ছি। লম্বা সালাম দিয়ে হাত পেতে বলে, ‘মার্কটে যাইন, স্যার? দোয়া করি, আল্লাহ য্যান ভালা জিনিস কিনতে দেয়। দোকানদার য্যান ঠকাইতে না পারে। ইয়া মাবুদ, তুমি স্যারের মনের আশা পুরা কইরা দিয়ো...!’
এমন দোয়ায় কিছু না দিয়ে পারা যায় না। মানিব্যাগ হাতড়ে দেখি ছোট নোট নেই। ভিখিরি দরাজ দিলে বলে, ‘১০০ টাকার নোটই দ্যান, স্যার। ভাংডি আছে।’
সুকন্যা আমাকে জ্ঞান দেওয়ার মোক্ষম সুযোগটা ছেড়ে দিল। ঈদের শপিংয়ে যাচ্ছে না! মুডে আছে।
পাড়ার স্কুটারচালকও কম যায় না। সে বায়না জুড়ে দিল, ‘দেড় শ টেকা তো স্যার এমনেই দেন, ঈদ উপলক্ষে না হয় আর ৫০ টেকা বেশি দিবেন। এইটা তো আফনেগো হাতের ময়লা।’
শপিং মলে ঢোকার আগে সুকন্যা আমাকে সতর্ক করে দিল, ‘তোমার কাজ শুধু মেয়েটাকে শক্ত করে ধরে রাখা। আর কিছু না।’
পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য হিসেবে মেয়ের আবদার মেটাতে হবে আগে। ওর পোশাক কিনতে বেবি কর্নারে যাই। বাহারি সব ফ্রক ঝোলানো। কিন্তু দামে আগুন। সুকন্যা বেশ উৎসাহ নিয়ে দরদাম করতে থাকে। আমি এসির মধ্যে থেকেও রুমালটা বের করে কপালের ঘাম মুছি।
মেয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘আমাকে কিন্তু লম্বা চুল আর হিল জুতো কিনে দিতে হবে।’
আমি হুঁ হুঁ করি। আশপাশে তাকিয়ে তামাশা দেখি। সুকন্যা বারবার সতর্ক করে, ‘দেখো, মেয়ের হাতটা আবার ছেড়ো না।’
মেয়ে তার মাকে আশ্বস্ত করে, ‘তুমি ভেবো না তো, মা। বাবাকে আমি ছাড়ব না।’
একটা দোকানে কলাপাতা রঙের একটা ফ্রক আমার খুব পছন্দ হয়ে যায়। ট্যাগে দাম দেখে তো খুশিতে আটখানা। মাত্র ৬০০ টাকা। উচ্ছ্বসিত হয়ে সুকন্যাকে দেখাই। দোকানের কর্মী দন্ত বিকশিত করে বলে, ‘এই ফ্রকটা সবাই খালি হাতায়। কেনে না। আপনিই স্যার সাহস দেখালেন।’
সুকন্যা ভুরু কুঁচকে বলে, ‘এখানে সাহসের কথা আসছে কেন?’
‘ছয় হাজার টাকার পোশাক কি আর সবাই কিনতে পারে?’
আমি আঁতকে উঠি, ‘এ্যাঁ, কী বলেন! এটার ট্যাগে তো ৬০০ টাকা লেখা!’
কর্মী এবার ট্যাগ পরখ করে হেসে ওঠে। বলে, ‘ওই যে বললাম, সবাই খালি হাতায়। হাতের ঘষায় ঘষায় একটা শূন্য মুছে গেছে।’
আমরা মানে মানে কেটে পড়ি।
বড়সড় একটা দোকানে অনেক ভিড়। সুকন্যা সেখানে গিয়ে গ্যাঁট হয়। যেন এখান থেকে না কিনলেই নয়। একটা সুন্দর ফ্রক পছন্দ হয়ে যায়। তা নিয়ে দোকানের কর্মচারীর সঙ্গে দরদাম করতে থাকে।
পাশ থেকে এক ভদ্রমহিলা আমাকে মধুর কণ্ঠে ডাকেন, ‘এই যে, ভাই, দেখুন তো!’
ঝুল দেওয়া একটা ঝলমলে পোশাক আমার সামনে তুলে ধরেন তিনি। সাক্ষী মানার ঢঙে বলেন, ‘বলুন তো, এই ড্রেসটার দাম চার হাজার টাকা হতে পারে? কোনো মানে হয়?’
আমি কোনো জবাব দেওয়ার আগেই পিঠে ঠোকনা। পাঁই করে ঘুরতেই সুকন্যা চাপা স্বরে শাসানি দেয়, ‘সুন্দরী মহিলা দেখলে আর হুঁশ থাকে না, না?’
আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করার আগেই আবার শাসানি, ‘চুপ, আর সাফাই গাইতে হবে না।’
দর-কষাকষিতে সুকন্যা একেবারে সুপটু। মেয়ের জন্য ফ্রকটা সে কিনেই ফেলে। আমি মেয়ের হাত ধরে ওর পিছু পিছু দোকান থেকে বের হই। কয়েক কদম যেতে না যেতে ছেলের কথায় সচকিত হই। ও বলে, ‘বাবা, তুমি কার হাত ধরে রেখেছ?’
দেখে তো আমার আত্মা উড়ে যাওয়ার জোগাড়। এ কার বাচ্চা! কাঁপন-ধরা গলায় বলি, ‘আমার মেয়ে কই?’
পেছন থেকে জবাব আসে, ‘এই যে আমি।’
আমার শার্টের কানা খামছে ধরে রেখেছে। সুকন্যা কটমট করে তাকায় আমার দিকে। ছেলে মিটিমিটি হাসছে। মেয়ের মুখ থমথমে। আমি অস্ফুট স্বরে বলি, ‘এ কার মেয়ে?’
আমার মেয়ের বয়সী মেয়েটি ভয়কাতুরে মুখে বলে, ‘আমি আম্মুর মেয়ে। আম্মুর সাথে এসেছি।’
‘আমার সঙ্গে এলে কীভাবে?’
‘বা রে, আপনিই তো আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলেন!’
সুকন্যা এগিয়ে এসে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আদুরে গলায় বলে, ‘কেউ টানলেই চলে আসবে, মা? তুমি কিছু বলবে না?’
‘আম্মু তখন আমার কান মলেছিল। তাই বলিনি।’
‘চলো, তোমাকে দিয়ে আসি।’
সুকন্যা মেয়েটাকে নিয়ে এগোয়। আমি মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ি। বিপদে পড়লে এই কাজে পাকা। এমন সময় মাইকে ঘোষণা আসে, ‘সাত বছরের একটি ছেলেকে পাওয়া গেছে। ছেলেটির নাম অর্ণব। পরনে...’
এ ঘোষণায় বুকটা দুরুদুরু করে। এখন মেয়েটার মাকে পাওয়া গেলে হয়। দুই মিনিটের মধ্যে সুকন্যা ফিরে এল। এসেই কটাক্ষ, ‘এ জন্যই তো এই লোকটাকে নিয়ে কোথাও যেতে চাই না!’
গজগজ করেই চলে সে। আমার মেয়েও রাগ দেখায়, ‘নিজের মেয়েকে বাদ দিয়ে অন্য মেয়ের হাত ধরে নিয়ে যাও। যাও, তুমি আমার বাবা না!’
আমি গায়ে মাখি না। ওদের এক গ্লাস করে বরফ দেওয়া স্মুদি খাওয়ালেই সব ঠান্ডা। যাক বাবা, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি! মেয়েটার মাকে পাওয়া না গেলে কী হতো!