
বাংলাদেশের ফরিদপুরের পদ্মার চর, সিলেট আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমসহ নানা প্রত্যন্ত এলাকায় ১৪ বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। কখনো কোনো চা দোকানে, কখনো গ্রামের কীর্তনের আসরে হাজির হন রেকর্ডিং যন্ত্রসহ। ধারণ করেন গান আর পরিপার্শ্বের শব্দ। ধারণকৃত এই শব্দই যেন একটা বিশেষ সময় ও অঞ্চলের প্রবহমান জীবনের ছবি হয়ে দাঁড়ায়। শব্দ দিয়ে এভাবে ছবি আঁকেন দুই ভারতীয় শব্দশিল্পী মৌসুমী ভৌমিক আর সুকান্ত মজুমদার।
১০ এপ্রিল নগরের গ্রন্থ বিপণিকেন্দ্র বাতিঘরে ‘শব্দ নিয়ে গল্প বলা’ শিরোনামের আয়োজনে এই দুই শিল্পী দর্শক-শ্রোতাদের সামনে মেলে ধরলেন তাঁদের অভিজ্ঞতার ভান্ডার। সোয়া ঘণ্টার আয়োজনে যেন দুই বঙ্গের একটা অচেনা ছবিই দেখা গেল।
এখনো গল্প লেখ অ্যালবাম দিয়ে এ দেশের শ্রোতাদের মনে আসন তৈরি করে নিয়েছিলেন মৌসুমী। তবে কেবল সংগীতশিল্পী ও গীতিকারের চেয়ে বেশি কিছু তিনি। একাধারে লেখক, গবেষক ও গানের সংগ্রাহকও। অপর দিকে, পুরস্কারপ্রাপ্ত অডিওগ্রাফার সুকান্ত মজুমদার শব্দ নিয়েই কাজ করেন। চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা তাঁর পেশা। পাশাপাশি শব্দ নিয়ে স্থাপনাশিল্পও করেন তিনি। তবে দুজনই এখন মগ্ন শব্দ-শ্রুতির দৃশ্যকাব্য রচনায়। ‘দ্য ট্রাভেলিং আর্কাইভ রেকর্ডস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানেরও জন্ম দিয়েছেন তাঁরা। যেখানে শব্দ, গান ও কবিতা সঞ্চিত হচ্ছে সময়ের চিহ্নসহ। এই আর্কাইভ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্পী কবিদের ধারণকৃত গান ও শব্দ নিয়ে এ পর্যন্ত বেরিয়েছে তিনটি অডিও অ্যালবাম। চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ ও সুষমা দাশ, সময়ের শব্দে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সংগস ফ্রম টুয়েন্টি সিক্স এজ নামের এসব অ্যালবাম সিডি আকারে এবং ‘দ্য ট্রাভেলিং আর্কাইভ রেকর্ডস’–এর ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে।
ট্রাভেলিং আর্কাইভ কেবল প্রত্যন্ত এলাকার বাউলদের গানের সংকলন নয়। গান ও কবিতার জন্ম যে অঞ্চল থেকে, সেই অঞ্চলের ভূগোল আর মানুষের মনস্তত্ত্বও তুলে ধরা হয়েছে এতে। এ জন্য অডিও সিডির সঙ্গে ইংরেজি ও বাংলায় রচিত ছোট পুস্তিকাও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানে মৌসুমী ভৌমিক দর্শকদের জানান, মূলত রেকর্ডিংয়ের ওপর ভিত্তি করে নবতর এক শিল্পভাষা নির্মাণের কাজ করছেন তাঁরা। রেকর্ডিংয়ের সূত্রে তাঁরা এ দেশের ফরিদপুর ও সিলেটে গিয়েছেন অসংখ্যবার। ফরিদপুরের শম্ভুনাথের চায়ের দোকানে প্রয়াত চলচ্চিত্রনির্মাতা বন্ধু তারেক মাসুদসহ অনেক বাউল ফকিরের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। সেখানেই দেখা বাউলশিল্পী লায়লা, হাবিব ও সাধক সালামতের সঙ্গে। পদ্মার চরে গিয়ে দেখা পেয়েছেন এন্তাজ ফকিরের।
নিজেদের কাজ সম্পর্কে মৌসুমী বলেন, ‘সুকান্ত মজুমদার আর আমি বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ আর সংলগ্ন নানা অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে গান রেকর্ড করি। আমাদের নানা মানুষের বন্ধুত্ব হয়। তাঁদের কাছ থেকে আমরা শুনতে শিখি। আমাদের এই শোনার গল্প অন্যদেরও শোনাতে চাই। শোনা বলতে শুধু গান শোনা নয়। যে শব্দ প্রকৃতি আর মানুষের জীবন থেকে উঠে এসে সুর হয়, কথা হয়, তাকেই আমরা বুঝতে চাই। আর যতটুকু পারি, আমাদের যন্ত্রে ধারণ করে রাখি। একে আমরা বলি শব্দে লেখা প্রবন্ধ বা অডিও এসে।’
পদ্মার বাউতিপাড়া বা বীরভূমের ময়না ডাঙা গ্রাম যেন মৌসুমী আর সুকান্তের কথায় তখন অনেকটাই রক্ত–মাংস পেতে থাকে। দর্শকও প্রত্যক্ষ করে অদেখা এক নতুন ভুবন।