শাশুড়ি আমার বিরুদ্ধে কথা বলেন

মেহতাব খানম
মেহতাব খানম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.
সমস্যা
আমি বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। ২৩ বছর বছর বয়সে পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে হয়। কিন্তু ছেলের মাদকাসক্তি ও শারীরিক অক্ষমতার জন্য নয় মাস পরেই  আমাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর মাঝে চার বছর বিরতি। এই চার বছর আমি উচ্চশিক্ষা নিয়েছি। ২৮ বছর বয়সে আমি আবারও বিয়ের পিঁড়িতে বসি। এবারও পারিবারিকভাবে বিয়ের পর সব ঠিকঠাক চলছিল। আর দশজন স্বামীর মতো আমার স্বামীও আমাকে ভালোবাসতেন। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকা শুরু করি। আমার বাবারা উচ্চমধ্যবিত্ত। আর শ্বশুর নিম্নমধ্যবিত্ত। শাশুড়ি প্রায়ই বাবার বাসা থেকে এটা-ওটা আনতে বলতেন। ননদেরা বয়সে অনেক বড়। তাঁদের সন্তানেরা প্রায় আমার সমবয়সী। তাঁদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ সংসার থাকা সত্ত্বেও স্বামী-সন্তানসহ বাবার বাসায় এসে থাকেন। রান্নাসহ সংসারের যাবতীয় কাজ আমাকেই করতে হতো। সেই সময়টিতে আমি কোনো কাজ করতাম না। আমার কাছে কোনো টাকাপয়সা থাকত না। স্বামীর কাছে টাকা চাইতে পারতাম না। এত বড় সংসার চালাতে ওর পুরো বেতনই খরচ হয়ে যেত। আমার ননদ এবং শাশুড়ি প্রায়ই আমার নামে উল্টাপাল্টা কথা বলতেন। বিয়ের দুই বছর পর আমি আমার মায়ের পরামর্শে ঢাকা চলে আসি এবং চাকরি করা শুরু করি। পেশায় আমি একজন চিকিৎসক। ভাইয়ের বাসায় থাকি। আমার স্বামী তার বাবা-মা ও বোনদের সঙ্গে অন্য শহরে থাকে। আমি চাই আমার স্বামী বদলি নিয়ে ঢাকায় চলে আসুক। আমরা একসঙ্গে সংসার শুরু করি। কিন্তু তার ঢাকায় আসার কোনো ইচ্ছা নেই। এ বিষয়ে কথা বললে এড়িয়ে যায়। বেশি বললে রেগে যায়। আমরা সন্তান নেওয়ার কথা ভাবছি। কিন্তু দুজন দুদিকে থাকলে কীভাবে এটা সম্ভব। সে আমার কোনো ভরণপোষণ দেয় না। এ প্রসঙ্গে কথা বললে বলে, তুমি শিক্ষিত মেয়ে। নিজেরটা নিজে করে নাও।

এবার ছুটিতে এসে লক্ষ করলাম, আমার অনুপস্থিতিতে আমার ননদেরা এবং শাশুড়ি ওকে আমার বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছে। এসব নিয়ে আমার স্বামী আমার সঙ্গে কথা বলে না। রাগ করে থাকে। উনারা যেটা বলেন, সেটাই বিশ্বাস করে।

নাম-ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক

পরামর্শ
মনে হচ্ছে, তোমার শ্বশুরবাড়ির মূল্যবোধ তোমাদের পারিবারিক বিশ্বাস ও চর্চার সঙ্গে মিলছে না​। উচ্চশি‌ক্ষিত মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তোমাকে একজন গৃহকর্মীর মতো সংসারের সব কাজ করতে হয়েছে।

শ্বশুরবাড়ির বৈষম্যমূলক আচরণ ও নির্যাতন থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া তোমার হয়তো আর কোনো উপায় ছিল না। তবে এত বড় একটি পদ‌ক্ষেপ নেওয়ার আগে তোমার স্বামীর সঙ্গে বসে ঠান্ডা মাথায় এই সিদ্ধা‌ন্তের কারণগুলো বোঝানো প্রয়োজন ছিল। সৌজন্য বজায় রেখে বিষয়টি তোমার শাশুড়ির সঙ্গে আলোচনা করলে ভালো হতো। তোমার স্বামী যে তাঁর পরিবার দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত হচ্ছেন, তা তো তুমি বুঝতেই পারছ। আমাদের দেশে ছেলেসন্তানদের শৈশব থেকেই পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করার মনোভাব তৈরি করে দেওয়া হয়।

স্বামীর হয়তো মনে হচ্ছে, তুমি উপার্জনক্ষম এবং তোমার নিজের মা-বাবার সহায়তা রয়েছে। তাঁর পরিবারে তো তিনি ছাড়া আর কোনো ভরসার জায়গা নেই। তিনি বুঝতে পারছেন না যে তাঁর জীবনের সঙ্গে আরও একটি মানুষের জীবন জড়িয়ে গেছে।

এই সম্পর্কটিকে সুস্থ ও সুন্দর করতে হলে দুজন একসঙ্গে থাকা খুব দরকার। এই মুহূর্তে সন্তান নেওয়ার কথা না ভেবে বরং তোমাদের দাম্পত্য সম্পর্কটির কীভাবে উন্নয়ন ঘটানো যায় সেটি বেশি জরুরি। শাশুড়ি-ননদের নেতিবাচক আচরণগুলো আলোচনা না করে, তোমরা এই বিবাহিত জীবনটিকে কীভাবে দেখছ, তোমাদের পারস্পরিক প্রত্যাশাগুলো কী এবং সেগুলো কতটা পূরণ হচ্ছে, তা বোঝার চেষ্টা করো।

তুমি তাঁর কাছে তোমার প্রত্যাশাগুলোর একটি লিখিত তালিকা দাও। সেই সঙ্গে তোমার কাছে তাঁর প্রত্যাশার একটি লিখিত বিবরণ নাও। তারপর দুজনে বসে আলোচনা করো সেগুলো পরস্পরের কাছে কতটা বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে।

এসব আলোচনায় তোমার মা-বাবা বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যের উপস্থিতি বিষয়টিকে আরও ঘোলাটে করে দিতে পারে। এ ছাড়া কারও স্ত্রী নয়, তুমি একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে আগামী পাঁচ কিংবা দশ বছর পর কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাও, সেটিও বোঝার চেষ্টা করো, তারপর সিদ্ধান্ত নাও।