
নারীর স্বনির্ভর হতে শিক্ষা বিস্তারের কোনো বিকল্প নেই। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর ইয়ং উইমেন-২০১৪’ শীর্ষক অধিবেশনে এ সত্যই বারবার উঠে আসে। ৪-১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের আয়োজক ছিল জাতিসংঘ নারী উন্নয়নবিষয়ক কার্যক্রম ইউএন উইমেন এবং ডাকসাং উইমেন্স ইউনিভার্সিটি। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ঘানাসহ ২৭টি দেশ থেকে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী এ সম্মেলনে অংশ নেন।
এ সম্মেলনে আমিসহ বাংলাদেশ থেকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাই ছয় শিক্ষার্থী। অন্যরা হলেন: আফসানা হক, সাবরিনা শাওরিন আলম, জিনাত ইসলাম, সেজানা ফাহমিদা ও আনিকা তাবাসসুম। কাকতালীয়ভাবে এবার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী সবাই ছিলেন বুয়েটের শিক্ষার্থী। নারীদের সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে আগ্রহী করা, গ্লোবাল পার্টনারশিপে উৎসাহিত করা এবং নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি আলোকপাত করা—এই লক্ষ্যগুলো সামনে রেখে অনুষ্ঠিত অধিবেশনের মূল থিম ছিল ‘নারীর ক্ষমতায়নের জন্য শিক্ষা বিস্তার’।

সম্মেলনের প্রথম তিন দিন (৪-৬ সেপ্টেম্বর) ছিল বিভিন্ন অধিবেশন ও সেমিনার। প্রথম দিন তিনটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো হচ্ছে অর্থনীতিতে উদ্যোক্তা হিসাবে নারী, ‘কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ’ এবং ‘আন্তবিশ্ববিদ্যালয় পার্টনারশিপ বাড়ানোর উপায় অনুসন্ধান।’
এসব প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীনের অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ এবং অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবৃন্দ। শিক্ষার্থী ও নবীন নারী উদ্যোক্তাদের সমস্যা এবং তা থেকে উত্তরণের নানা দিকনির্দেশনা দেন বিশেষজ্ঞ বক্তারা।
দ্বিতীয় দিন প্রথমার্ধে নির্ধারিত ছিল ধারণাপত্র উপস্থাপনের জন্য, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে নির্বাচিত ২০টি দল চিন্তাভাবনা তুলে ধরে। বাংলাদেশের দুটি দলই এই পর্বে ধারণাপত্র উপস্থাপনের সুযোগ পায়। দ্বিতীয় দিন দ্বিতীয়ার্ধে ভোটের মাধ্যমে ইউএনডব্লিউপির স্টুডেন্ট অর্গানাইজিং কমিটির সভাপতি, সহসভাপতি, এশিয়ান রিপ্রেজেন্টেটিভ ও আফ্রিকান রিপ্রেজেন্টেটিভ নির্বাচন করা হয়। এ নির্বাচনে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল বিশাল চমক! অংশগ্রহণকারী সবার ভোটে এশিয়ার ২০টি দেশের মধ্য থেকে ‘এশিয়ান রিপ্রেজেন্টেটিভ’ হিসেবে আমাকে নির্বাচিত করা হয়। রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে নির্বাচিতদের দায়িত্ব হচ্ছে ইউএনডব্লিউপির বিভিন্ন কাজে সহায়তা করা, আগামী ইউএনডব্লিউপি সম্মেলনে বিশেষ সেশন আয়োজন করা এবং বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধি নির্বাচনে সহায়তা করা।
সেদিন রাতেই অন্যতম আকর্ষণ ছিল অংশগ্রহণকারীদের নিজ নিজ দেশের সংস্কৃতি তুলে ধরার জন্য ‘গ্লোবাল কালচারাল ফেস্টিভ্যাল’। বলাই বাহুল্য, সেই অনুষ্ঠানে আফ্রিকান সাম্বা নাচ থেকে শুরু করে কোরিয়ান গ্যাংনাম স্টাইল পর্যন্ত বাদ যায়নি। নাচের সঙ্গে ইথিওপিয়ান চা পরিবেশনাসহ আরও অনেক মনকাড়া নৈপুণ্যে সেটি ছিল এক স্মরণীয় সময়। এই উৎসবে সবার সামনে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য প্রকাশের জন্য আমরা বিষয় হিসেবে বেছে নিই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’কে এবং ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করি আমার ও সাবরিনার কবিতা আবৃত্তি, সঙ্গে আফসানার নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে।
বাকি দিনগুলোর জন্য নির্ধারিত ছিল বিভিন্ন কর্মশালা, দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন ও মতবিনিময়ের।
দুই সপ্তাহের দক্ষিণ কোরিয়া সফরে আমাদের জানার সুযোগ হয়েছিল নানা দেশের নানা সংস্কৃতিকে। আলাপের সুযোগ হয়েছে বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। বন্ধুত্ব হয়েছে অনেকের সঙ্গে। বিশেষ করে বলতে হয় কোরিয়ার লি সংহি, কিম, জুলিয়া লিম, মালয়েশিয়ার ইদা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লিয়াহ ও ঘানার ক্যারিন–এর কথা।
কোরিয়ার পথে পথে যেখানেই গেছি, মনে হয়েছে ওখানে নারীদের পায়ে কোনো ‘অদৃশ্য শৃঙ্খল’ পরানো নেই। মেয়েরা ইচ্ছা করলে সব সময় যেকোনো জায়গায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছে, কোনো সামাজিক বিধিনিষেধের বালাই নেই। বাংলাদেশে ঠিক তার উল্টো। কোরিয়ার এই সম্মেলনে অংশ নিয়ে তাই বারবার মনে হয়েছে, আমাদের আরও পথ পাড়ি দিতে হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য যেতে হবে বহু দূরে, যার শুরুটা হতে হবে সর্বস্তরে মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে।