
চরাচর এখন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। মাঘ মাস বলে কথা। কোনো কোনো দিন এমনও হয়, সূর্যের মুখই দেখা যায় না। সকালও যেমন, ভরদুপরও তেমনই। ঘড়ির দিকে না তাকালে বেলা ঠাহর করা দায়। তার ওপর কনকনে হাওয়ার ঝাপটা। জীবনযাত্রা যবুথবু।
শীতে চাদর মুড়ি দেওয়ার রেওয়াজ নতুন নয়। প্রকৃতি জড়িয়েছে কুয়াশার চাদর, আর লোকজন মস্তকসমেত শরীরের ঊর্ধ্বাংশ ঢেকেছে পশম বা তুলার তন্তুর চাদরে। কোট, জ্যাকেট, জাম্পার প্রভৃতি যত কেতাদুরস্তই হোক, শীত আটকাতে চাদর মুড়ি দেওয়ার উষ্ণ অনুভবের তুলনা হয় না। উপমহাদেশে, বিশেষত এই বাংলায় শীতবস্ত্র হিসেবে চাদরের ব্যবহার চলছে প্রাচীনকাল থেকে। অভিজাত শ্রেণির লোকেরা কাঁধে ঝোলান সূক্ষ্ম সুতার কারুকাজ করা বিখ্যাত কাশ্মিরী শাল। গরিবের গায়ে সুতির চাদর।
আরও এক প্রকারের জিনিস আছে, তা হলো উত্তরীয়। শীত নিবারণের চেয়ে এই বস্তুটি অধুনা সম্মাননা জ্ঞাপনার্থেই বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উত্তরীয়ের সঙ্গে বেশ রাবীন্দ্রিক ভাব আছে। কবি নিজেও লিখেছিলেন ‘গন্ধে উাদাস হাওয়ার মত উড়ে তোমার উত্তরী/ কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী’। তো এই উত্তরী বা উত্তরীয় শীত-গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই প্রদান করা হয়ে থাকে গুণীজনের সংবর্ধনায়।
চাদরের প্রচলন কবে থেকে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা শক্ত। শীত নিবারণকারী এই বস্ত্রখণ্ডটি বেশ কয়েটি নামে পরিচিত। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ -এ চাদরের অর্থ ‘উত্তরীয়, দেহের উপরি ভাগে ধারণীয় বস্ত্র।’ ‘আলোয়ান’ বললে বোঝাবে সেই চাদরটিকে যা লোমজাত তন্তুতে তৈরি, এবং পাড়হীন। পাড়যুক্ত পশমি চাদর যাকে আমরা সচরাচর বলছি ‘শাল’, সেটিকেই এককালে ‘রেপার’ নামে চিনতেন সবাই। রেপার নামটি এখন আর চলে না। শরৎবাবু চমৎকার লিখেছিলেন শীতের রাতে রেপার জড়িয়ে নতুন দা নৌভ্রমণ বৃত্তান্ত।
দরদাম : নাম পরিচয় যথেষ্ট হলো। এবার দরদামের পর্বে আসা যাক। আমাদের দেশে আলোয়ান, রেপার তৈরি হয় না। ‘কাশ্মিরী শাল’ বলে ব্যাপক পরিচিত এই শীতবস্ত্রটি ভারতের কাশ্মির ও পাকিস্তানি কাশ্মির উভয় এলাকাতেই তৈরি হয় এবং আমাদের দেশেও বেশ সহজলভ্য। নয়া পল্টনের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হায়দার এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক এমদাদ উল্লাহ জানালেন, পুরুষদের চিকন পাড় শালের (পাকিস্তানি) দাম ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। মোটা পাড় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। মহিলাদের শাল (সিঙ্গেল) ৬৫০ থেকে এক হাজার টাকা। ভারতীয় শালের দাম এর চেয়ে কিছুটা চড়া। পাড়হীন শাল অর্থাৎ আলোয়ান আছে বেশ কয়েক রকমের। বুননের বৈচিত্র্যের ওপর এগুলোর দাম নির্ভর করে। তুষ, নূর এমন বিভিন্ন ধরনের নাম আছে এসব শালের। দাম একটু বেশি। ওম হয় ভালো। পাওয়া যাবে নিম্নে ১ হাজার ৫০০ থেকে ঊর্ধ্বে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত।
মহিলাদের চাদরের বাজার চীনের দখলে। গাজী ভবনের মালিহা ফ্যাশনের বিক্রয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ লিটন জানান, নরম কৃত্রিম তন্তুতে তৈরি হরেক রকম রং ও নকশার চাদর পাওয়া যায়, নিম্নে ৩০০ টাকা থেকে ঊর্ধ্বে ৮০০ টাকার মধ্যে। দেশের তৈরি কৃত্রিম তন্তুর হরেক রকম চাদর পাওয়া যায় অভিজাত বিপণিবিতান থেকে ফুটপাত অবধি। দামও আহামরি কিছু নয়, ৫০০ টাকা থেকে নিম্নে ১৫০ টাকায় পাওয়া যাবে গায়ে জড়ানোর এই উষ্ণ বস্ত্রখণ্ডটি।
তবে চাদরের সঙ্গে যে কেবল শীতেরই একচেটিয়া কারবার, তা মনে করলে নেহাত ভুল হবে। ‘নিরাপত্তার চাদর’ কথাটিও মাথায় রাখুন। এই চাদরটির ব্যবহারই এখন বেশি। কেবল শীতে নয়, সারা বছর। প্রায়ই শোনা যায়, নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলার ঘোষণা। জীবনের জন্য উষ্ণতা যেমন, নিরাপত্তার প্রয়োজনও তেমনই অপরিহার্য। অতএব, চাদর জয়তু।