গরু নাকি গোরু?
চিরচেনা শব্দটির নতুন বানান–বিতর্কে গত বছর সরব হয়ে উঠেছিল ফেসবুক। আলোচনা গড়িয়েছিল সংবাদপত্রের পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়। যার শুরু হয়েছিল একটি ফেসবুক গ্রুপে। তারা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলা একাডেমি: আধুনিক বাংলা অভিধান থেকে তথ্যটি জানিয়েছিল। তাতে অবশ্য শব্দ অনুসন্ধিৎসু মানুষের লাভই হয়েছে, ভাষা গবেষকদের লেখায় জেনেছেন ‘গরু’ শব্দের গোড়ার কথা।
ফেসবুকে গ্রুপটির নাম—শুদ্ধ বানান চর্চা। সংক্ষেপে ‘শুবাচ’। বাংলা একাডেমির অভিধান মেনে শুবাচ সরব বাংলা শব্দের শুদ্ধতা নিয়ে। সদস্যদের মধ্যে শব্দের হালচাল নিয়েও চলে বিস্তর আলোচনা। সহজে শুদ্ধ শব্দ মনে রাখার উপায়ও বাতলে দিতে লেখা হয়েছে বেশ কিছু নিবন্ধ। বিসিএস পরীক্ষা যাঁদের লক্ষ্য তাঁদের জন্যও রয়েছে বাংলা চর্চার আয়োজন। ফেসবুকে বাংলা ভাষা বিকৃতির সংশয় যখন অনেকের লেখায় আর কথায়, ঠিক তখনই বাংলা ভাষা চর্চায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব এই গ্রুপটি।
শুবাচের উপদেষ্টা পর্ষদে আছেন অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস প্রমুখ। তাঁরা অবশ্য ফেসবুক গ্রুপে নেই, কোনো শব্দ নিয়ে খটকা লাগলে শুবাচ দ্বারস্থ হয় এই বিজ্ঞজনদের। এদিকে গ্রুপের সদস্যদের পোস্ট ছাড়া, মন্তব্য দেখা, আলোচনাসহ গ্রুপটি সামলান দেশের নানা প্রান্তে থাকা একদল তরুণ। তাঁদের অগ্রভাগে অবশ্য আছেন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ড. মোহাম্মদ আমীন। শুবাচের পেছনের এই মানুষেরা নিজেদের পরিচয় দেন ‘শুবাচি’ বলে। শুবাচের স্লোগানে তাঁরা বলছেন, ‘শুদ্ধ বানান, শুদ্ধ ভাষা, বাংলা আমার ভালোবাসা’।
বাংলা ভালোবেসেই প্রতিষ্ঠাতা এবং গ্রুপ পরিচালকেরা ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন, চর্চা করেন। মোহাম্মদ আমীন বাংলা ভাষা নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু বই। শুবাচ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে চারটি লিটল ম্যাগাজিন। মোহাম্মদ আমীন বলছিলেন, ‘গ্রুপের নাম শুদ্ধ বানান চর্চা হলেও, শুধু শুদ্ধ বানান নয়, বাংলা ভাষা নিয়েই তৎপর আমরা।’
২০১৩ সালের ৩ অক্টোবর খোলা হয় গ্রুপটি। এখন সদস্যসংখ্যা প্রায় ৭ লাখ ২৫ হাজার। মোহাম্মদ আমীন বললেন, শুদ্ধ বানান চর্চা ও বাংলা বানানে প্রমিত নিয়ম প্রয়োগে উৎসাহ দেওয়া, বাংলা বানান ও শব্দচয়নে ভুল কিংবা যথেচ্ছাচার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি, বাংলা ভাষার প্রচার-প্রসার ও সমৃদ্ধ করতে আলোচনা-পর্যালোচনা, গবেষণা ও বই প্রকাশ এবং লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মিলিতভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এই গ্রুপের উদ্দেশ্য।
শুবাচে এক চক্কর
প্রায় ৭ লাখ ২৫ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারীর গ্রুপটি সব সময় সরব থাকে শব্দ, বাক্য, ব্যাকরণ নিয়ে। এটি পরিচালনা করেন ৯ অ্যাডমিন। সদস্যরা গ্রুপের নীতিমালা মেনে প্রশ্ন করতে পারেন, জানাতে পারেন শব্দ কিংবা বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে নিজের মতামত। তবে যেসব শব্দের অর্থ অভিধান থেকেই জানা যায়, সেসব শব্দের অর্থ জানার জন্য শুবাচে স্ট্যাটাস না দেওয়ার ব্যাপারেও নীতিমালায় অনুরোধ করা হয়েছে।
১৮ ফেব্রুয়ারি এ এইচ ইনসান নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী গ্রুপে জানতে চেয়েছেন, অপেক্ষা আর প্রতীক্ষা শব্দ দুটির মধ্যে পার্থক্য কী? আরেক সদস্য জেড রাজার জিজ্ঞাসা, ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটার উৎপত্তি কীভাবে? শেখ সাদি দেওয়ান প্রশ্ন করেছেন, দ্বিতীয়া তৎপুরুষেও ‘কে’ বিভক্তি আবার চতুর্থী তৎপুরুষেও ‘কে’ বিভক্তি, তাহলে সমাস নির্ণয়ে কীভাবে বুঝব দ্বিতীয়া নাকি চতুর্থী? মো. আবদুল্লাহ খান জানতে চেয়েছেন, নিকষ কালোর ‘নিকষ’ শব্দের অর্থ কী?
এসব প্রশ্নের উত্তর মন্তব্যে জানিয়েছেন অন্য সদস্যরা। উত্তরে মজার উদাহরণ যুক্ত করেছেন কেউ কেউ, কেউ আবার বইয়ের সূত্র থেকেও তুলে দিয়েছেন ব্যাখ্যা। গ্রুপে এসব প্রশ্ন নিয়ে আগে যে আলোচনা হয়েছিল, একজন অ্যাডমিন মন্তব্যে দিয়েছেন সেই লিংকও।
এই গ্রুপের অন্যতম অ্যাডমিনদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এ বি ছিদ্দিক। তিনি জানালেন, এই গ্রুপে যুক্ত হওয়ার পর একসময় তাঁর আগ্রহ দেখে গ্রুপ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ছিদ্দিক বলেন, ‘শব্দ নিয়ে কাজ আমার সাধনা বলতে পারেন। এখানে সব সময় শব্দের সঙ্গে থাকা যায়।’
নির্ভুল শব্দের আহ্বানে
ঘুষ নাকি ঘুস, পোশাক নাকি পোষাক, প্রবাহমান নাকি প্রবহমান—বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধান অনুসরণ করে শতাধিক পর্বে শব্দগুলোর বানান প্রচার করেছে গ্রুপটি। এই প্রচারণার নাম ছিল ‘একটি শব্দ হলেও হোক নির্ভুল’। কোনো কোনো শব্দ নিয়ে অবশ্য বিতর্কও উসকে দিয়েছিল।
এ ছাড়া বাংলা একাডেমি: প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম বই নিয়ে ১৬ পর্বে পোস্ট আছে গ্রুপে। এসব পোস্ট সহজে পেতে লিংক সংরক্ষণ করা হয়। তৎসম চেনার সহজ কৌশল, পড়া বনাম পরা, কি বনাম কী: কিভাবে কীভাবে, কিসে কীসে, কোথায় হবে ‘টি’এবং কোথায় হবে ‘টা’, ব্যাবহারিক না ব্যবহারিক—এগুলো নিয়ে গ্রুপে চলে নিয়মিত আলোচনা।
তাসলিমা পারভীন গ্রুপের একজন সদস্য। তিনি বললেন, ‘এই গ্রুপে থাকার সুবিধা হলো সব সময় শব্দের সঙ্গে থাকা যায়। নিয়ম করে বই না খুলেও বাংলা শব্দ নিয়ে দারুণ কিছু শেখা যায়। খটকা লাগা শব্দ নিয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়।’
তাসলিমার মতো এমন উত্তর পাওয়া গেল আরও কয়েকজন গ্রুপে যুক্ত মানুষের কাছে। তাঁদের এই আগ্রহের কারণেই বাংলা বানান চর্চার গ্রুপটি হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়, প্রাণবন্ত।
প্রমিত বাংলা ব্যবহারে সহায়তা ফেসবুকে
সরকারি কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহারে সহায়তা প্রদান করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিচালনা করে একটি ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপ। ‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ (বাবাকো), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়’ নামে ২০১৬ সালে চালু হওয়া গ্রুপটিতে ফেসবুক ব্যবহাকারী ৩ হাজার। একজন সেবাদান কর্মকর্তা অফিস চলার সময়ে দায়িত্ব পালন করেন। চাইলে যে কেউ প্রশ্ন করে তাৎক্ষণিক শব্দ ও বাক্য সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন গ্রুপটিতে।
সেবাদান কর্মকর্তা মো. মোস্তফা শাওন বলেন, গ্রুপ থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচ শর বেশি সমাধান দেওয়া হয়েছে। আমরা টেলিফোনেও সেবা দিয়ে থাকি।
বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ: fb.com/groups/243053389363488