
খুব অভিমান হলে চোখমুখে লাল আভা খেলে যেত ওর। সেদিনের অভিযোগটা ছিল এ রকম, ‘কাল আপনার প্রিয় শেওলা রঙের জামাটা পরেছিলাম, অথচ কালই আসেননি।’ আমি অভিমানের বরফ গলিয়ে দেব বলে ওর আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে দিতে গেলেই হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘থাক, লাগবে না।’ আমি তখন ওর অলংকারহীন মুখের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হব বলে চোখে চোখ রাখতে যাই। শেষবার ও মুখ কালো করে বলে, ‘থাক, লাগবে না।’
আমরা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসি, এ কথা কখনো মুখ ফুটে বলিনি; কিংবা শব্দ করে বলার সুযোগও মেলেনি। বন্ধু মোহনাও খুব করে জানতে চাইত—আমাদের এই মূক প্রেমের কথাকলিরা শব্দ ফুল হয়ে ফুটেছে কি না। ওপাশ থেকে মোহনা প্রথমেই যে কথাটি বলত, ‘কিরে, আজকেও বলতে পারলি না, তাই তো?’ আমি ওকে শাসানোর সুরে বলতাম, ‘ওই, ফোন রাখবি?’
কোনো এক বর্ষার দিনে কাকভেজা হয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ওর বাসার কলবেল বাজিয়েও ভেতর থেকে সাড়া পাচ্ছিলাম না। ব্যর্থ চেষ্টা শেষে ফিরে আসব, এমন সময় পেছন থেকে ডাক। বৃষ্টিবিলাসে ও ছাদে ছিল, আর আমি ছিলাম রাস্তায়। জবুথবু ও আমাকে ভেতরে নিয়ে তোয়ালে বাড়িয়ে দিতে গেলে আমি তোয়ালের বদলে ওর হাতকেই ছুঁয়েছিলাম। বৃষ্টিস্নাত তরুণীর সৌন্দর্য লেপ্টে থাকা জামার ভাঁজে ফুল হয়ে ফুটলে ভুল করে দেখতে গেলেই অপবাদ, ‘এই যে মাস্টার, শিক্ষকদের অতটা বেহায়াপনা চলে না।’ ও আমাকে বসিয়ে রেখে স্নানঘরে যায়। আমি ওর দেওয়া তোয়ালেতে মাথা মুছি, হাত মুছি। নাকের কাছে বহুক্ষণ ধরে রেখে ওর গায়ের গন্ধ শুঁকি।
তারপর লম্বা সময়ের বিরতি শেষে জল চুইয়েপড়া চুলগুলোকে পিঠের ওপর ছড়িয়ে দুই কাপ কফি নিয়ে আমার সামনে বসে। আমি বিস্ময়াভূত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে ও বলতে থাকে, ‘নিন না, আজকে আম্মা বাসায় নেই। তাই পড়ব না।’ ও সেদিন পড়েনি। তবে আমি পড়েছিলাম, ওর চোখকে পড়েছিলাম। ওর দিকে নিবিষ্টচিত্তে তাকিয়ে থাকলে আচমকা এক প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘সাহস আছে বুকে? পারবেন আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে?’ আমি সেদিন ওকে থামিয়ে দিয়ে বলি, ‘তোমার পরীক্ষা যেন কবে?’ ও উত্তর দেয়, ‘এই তো তিন মাস...!’
ও জানে না, আমার মতো নিম্নমধ্যবিত্ত গৃহশিক্ষকের সেই ক্ষমতা বা সাহস কোনোটাই নেই। আমাকে নিযুক্ত করা হয়েছে ওর হিসাববিজ্ঞানে বেহিসেবি হারে ফেল করা থেকে উদ্ধার করতে। তরতাজা বেলিফুলের সৌরভে মাতোয়ারা ভুলিয়ে-ভালিয়ে পালিয়ে যেতে নয়। আমি আমার আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে দায়িত্বজ্ঞানের অধ্যায়গুলো মাথায় নাড়ি। সেদিন থেকে আমাকে খুব বেশি সজাগ ও সাবধানি হতে হয়েছিল। নিজেকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হতো যে, আমি ওর টিচার।
এর আরও মাস ছয়েক পরে হাতে এল নিমন্ত্রণপত্র। দেড় বছরের আসা-যাওয়ায় আমি আর টিউটর নয়, বনে গিয়েছিলাম ওদের পরিবারেরই একজন। ওর মা আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি আমার বাসার টিউটর নও, মনে করো তুমি শোভার ভাই। বিয়েতে তুমি আসবে কিন্তু...।’ আমি ওর বিয়েতে গিয়েছিলাম। বান্ধবীদের সরিয়ে দিয়ে কেবল একান্তে আমাকেই একমুহূর্তের জন্যই চেয়েছিল ও। তারপর বলেছিল, ‘ছিঃ, কাপুরুষ কোথাকার...।’
ইংরেজি বিভাগ, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ