সন্তানের আচরণ বদলাতে...

সাঁঝবাতি ও জুভানা এই দুই বোনের মতো উচ্ছ্বল কৈশোরইতো চায় মা–বাবারা।  ছবি: অধুনা
সাঁঝবাতি ও জুভানা এই দুই বোনের মতো উচ্ছ্বল কৈশোরইতো চায় মা–বাবারা। ছবি: অধুনা

১০ বছর বয়সী সামিউল। এমনিতে সব দিক দিয়ে ভালো ছেলে। তবে ইদানীং দেখা যাচ্ছে যে সে মা-বাবার কোনো কোনো কথার বিরোধিতা করছে। এমনকি তার পছন্দের বিষয়গুলোও যদি তাঁরা করতে বলেন, তখন সে তা আর করতে চায় না। তাঁদের কথার সঙ্গে একধরনের বিপরীতমুখী আচরণ সে করতে থাকে। তাকে নিয়ে তার মা-বাবা বেশ চিন্তিত।
১৩ বছরের মেয়ে সুস্মিতা। তার সমস্যাও প্রায় কাছাকাছি। বেড়াতে যাওয়ার সময় মা হয়তো একটি পোশাকটি তাকে পরতে বললেন—সেটি সুস্মিতার পছন্দ নয়, সে নিজের পছন্দমতো পোশাক বেছে নিচ্ছে। মা তাকে যা করতে বলছেন সে সেটি কোনোভাবেই করতে চায় না।
সামিউল বা সুস্মিতার মতো এমন কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে অনেক মা-বাবা চিন্তিত, বিব্রত ও শঙ্কিত থাকেন। বয়ঃসন্ধিকালের এই শিশুরা কখনো কখনো এ ধরনের আচরণ করতে পারে। এটি তাদের একধরনের আচরণজনিত সমস্যা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাদের এই অবাধ্য আচরণ কেবল মা-বাবার সঙ্গে বাড়িতে, অন্য কোথাও তাদের কোনো সমস্যা নেই। কখনো এটি হতে পারে বয়ঃসন্ধিকালের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা, কখনো তা বয়ঃসন্ধির সংকট, কখনো বাবা-মায়ের আচরণ তাদের এমনটা করতে বাধ্য করে। আবার কখনো-বা অপজিশনাল ডেফিয়েন্ট ডিসঅর্ডার নামক মানসিক সমস্যার কারণে এমনটা করে থাকে।
সাধারণত অন্যায় বা সমাজবিরোধী কোনো কাজ এই কিশোর-কিশোরীরা করে না কিন্তু তাদের আচরণে বাবা-মা প্রায়ই বিরক্ত হয়ে ওঠেন। যেমন বাবা-মা ঠিক করলেন তাঁরা সপরিবারে বেড়াতে যাবেন ঢাকার বাইরে। কিন্তু তাঁদের সন্তান বিগড়ে গেল, সে কিছুতেই বেড়াতে যাবে না। তার নাকি কাজ আছে, বেড়াতে ভালো লাগে না ইত্যাদি ইত্যাদি। বাসায় মেহমান এসেছেন, বাড়ির ছেলেটিকে বলা হলো মেহমানের সঙ্গে পরিচিত হতে, সে কিছুতেই নিজের ঘর থেকে বের হচ্ছে না। উৎসবের দিনে মা চাইলেন তাঁর মেয়েটি তাঁর সঙ্গে মিলিয়ে একই রঙের পোশাক পরবে; সেভাবে পোশাক কিনলেন কিন্তু মেয়েটি কিছুতেই সে পোশাক পরবে না।
কারণ যা-ই হোক না কেন, এ ধরনের আচরণ থেকে তাদের মুক্ত করতে হলে মা-বাবাসহ পরিবারের অন্য অভিভাবকদের খানিকটা সচেতন হতে হবে। সন্তান যাতে এমনটা না করে সে জন্য বাবা-মায়েরা যা করতে পারেন—
নিয়ম তৈরি: বাড়িতে একটি নিয়ম তৈরি করুন এবং ছোটবেলা থেকেই সন্তানসহ বাড়ির সবাইকে নিয়ম মেনে চলতে উৎসাহিত করুন।
•গলার স্বর উঁচু নয়: সন্তান কথা না শুনলে তাকে বুঝিয়ে বলুন, উচ্চ স্বরে উত্তেজিত হয়ে তাকে কোনো আদেশ দেবেন না। ধমকাবেন না।
•একই কথা বারবার নয়: সন্তানকে একই নির্দেশ বারবার দেবেন না। সে যদি আপনার কথা না শোনে তবে সময় নিন এবং কিছু সময় পরে সেটি আবার বলুন। ক্রমাগত একই নির্দেশ বা অনুনয় করবেন না।
•সময় নিন: সন্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে সময় নিন, এক মুহূর্তে সবকিছু ঠিক করে ফেলতে চাইবেন না। সন্তানকে শোধরাতে চুপ থেকে সময় দিন, তর্ক করে সময় নষ্ট করবেন না।
•সন্তানের সাফল্যকে উদ্যাপন করুন: সন্তানের ছোট-বড় সব অর্জনকে প্রশংসা করুন, মাঝে মাঝে তা উদ্যাপন করুন।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন নয়: সন্তান কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কী পড়ছে সেসব বিষয়ে নিজে পরিষ্কার ধারণা রাখুন। উদাসীনতা নয় মোটেও। তাদের শিক্ষক, বন্ধু এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন।
•সন্তানের ব্যক্তিগত বিষয়ে গোপন খবরদারি নয়: বয়ঃসন্ধিকালের সন্তানের ব্যক্তিগত বিষয় তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জানার চেষ্টা করুন। গোপনে, তার অজান্তে গোয়েন্দাগিরি নয়।
•বাড়াবাড়ি নয়: ওরা যদি আপনার কথা না শোনে, তবে জোর করে তাকে বাধ্য করবেন না, আপনার কথা না শোনার কুফলটি তাদের ভোগ করতে দিন, যাতে তারা নিজেরাই বুঝতে পারে যে বাবা-মা সঠিক কথাই বলেছিলেন।
•নিজেদের দায়ী করবেন না: সন্তানের সমস্যা নিয়ে বাবা-মা যেন একে অপরকে দায়ী না করেন, নিজেদের মধ্যে যেন দাম্পত্য কলহে জড়িয়ে না পড়েন।
•নিরপেক্ষ বিষয় বেছে নিন: যেসব বিষয় নিয়ে সন্তান সমস্যা তৈরি করে, সেসব বিষয় খানিকটা এড়িয়ে অন্যান্য বিষয়কে প্রাধান্য দিন, তাতে করে দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে এমন বিষয় কমে যাবে আর নিরপেক্ষ বিষয়ের চর্চা বেশি হবে।
•সামাজিক দক্ষতা: বাবা-মায়েরা নিজেরা সামাজিক দক্ষতা অর্জন করুন, রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখুন এবং শিশুদের ছোটবেলা থেকেই সামাজিক দক্ষতা অর্জন করতে শেখান।
•ব্যর্থতাও জীবনের অংশ: সফলতার মতো ব্যর্থতাও যে জীবনের একটি অনুষঙ্গ, শিশুদের তা মেনে নিতে শেখান।
•চাপ নয়: তোমাকে জিপিএ-৫ পেতেই হবে, তোমাকে অমুক জায়গায় ভর্তি হতেই হবে, এমন ধরনের চাপ শিশুর ওপর দেবেন না।
•মতামতের গুরুত্ব: ছোটবেলা থেকেই তাদের মতামত নিন, সব সময় যে তাদের মত অনুযায়ী চলতে হবে তা নয়, তবে শিশুদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের দিয়েই তাদের জন্য উপযুক্ত সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করাতে চেষ্টা করুন।
নিজের যত্ন নিন: বাবা-মা সন্তান সন্তান করে যেন নিজেরাই অসুস্থ হয়ে না পড়েন। নিজেদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা অনেক জরুরি। নিজের মধ্যে বিষণ্নতা গড়ে উঠলে সন্তানের সব কাজকে নেতিবাচক মনে হবে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা