
এই পৃথিবীতে ভুল-বোঝাবুঝি কাদের মধ্যে না হয়? স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বস-অধস্তন সব সম্পর্কেই কমবেশি ভুল-বোঝাবুঝি, মানসিক টানাপোড়েন ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকে। বলা হয় প্রতিটি ঘাতেরই প্রতিঘাত থাকে। সচেতনতার সঙ্গে সমস্যাগুলো না মেটালে এ ঘাত-প্রতিঘাতের জের চুইংগামের মতো লম্বা হতে থাকবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি এর রাশ টেনে ধরবেন। দূরত্ব বাড়বেই।
পারিপার্শ্বিক নানা ঘটনা, বাস্তবতার কারণে মা-বাবা, সন্তানের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি ও মানসিক টানাপোড়েন আমরা কখনো আমলে নিই না। কারণ, এই আবেগপ্রবণ বিশ্বাস প্রবল থাকে যে কখনো তাঁরা সন্তানের খারাপ চাইবেন না। সব সময় ভালোবাসার ডালি পেতে রাখবেন। দেখা যায়, এই সুযোগে সন্তান তার ষোলো আনা আদায় করার চেষ্টায় থাকে। তাঁরা অনেক সময় মা-বাবার অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে কসুর করে না। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং বলে একটা কথা চালু আছে। আবার উল্টো চিত্র যে সমাজে দেখা যায় না, তা কিন্তু নয়। কোনো কোনো মা-বাবা তাঁদের কঠোর শাসন ও আচরণ দিয়ে ছেলেমেয়ের জীবন সুখের বদলে তিক্ততায় ভরিয়ে দেন। সন্তানের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে অক্ষমতা বা অনীহা, দুই প্রজন্মের চাহিদা ও বিশ্বাস, ধ্যানধারণার মধ্যে অমিল, অনেক সময় সন্তানের বিয়ে ও বৈবাহিক জটিলতা, সংসার নির্বাহ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এই সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরায়। আস্তে আস্তে সময়ের প্রয়োজনে এই চিরচেনা মুখগুলো অচেনা মনে হয়।
মা-বাবার ব্যস্ততা, সন্তানদের ব্যস্ততা কিংবা শাশুড়ি-বউয়ের পারস্পরিক ঈর্ষা থেকেও ভুল-বোঝাবুঝি হয়। সন্তান বড় হয়ে গেলে একাকিত্বে ভোগেন মা-বাবা। তখনো মনের মধ্যে নেতিবাচক কথা ঘোরে। অনেক মা-বাবা সন্তানকে গুণগত সময় দিতে পারেন না বা দেন না। এটি থেকেও দূরত্ব তৈরি হয় মা-বাবা ও সন্তানের মধ্যে।
এ অবস্থায় কি করণীয়! মার্কিন লেখক সি জয়বেল সি সমস্যার সুরাহা বাতলেছেন এই ভাষায়, সন্তানকে এমনভাবে লালনপালন করতে হবে, সে যেন নিজের মতো করে বড় হওয়ার ফুরসত পায়। তার মধ্যে যেন আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রবল ইচ্ছা তৈরি হয়। তার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা যেন তাকে ক্রমেই শক্তিশালী হতে সাহায্য করে।
ইংরেজি ভাষার অভিভাবকত্ব-পরামর্শ লেখক এডেলে ফেবার (জন্ম-১৯২৮) এ নিয়ে কৌতুক করতে ছাড়েননি। বলছেন, ‘দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। বিষয়টা যেন এমন না হয় যে সন্তান না হলে আমি দারুণ অভিভাবক হতে পারতাম।’
মা-বাবার যা ভেবে দেখা উচিত
মা-বাবা হিসেবে ভালোবাসা সর্বদাই অনিঃশেষ হয়ে থাকে। আদর, স্নেহ, আশ্রয়, প্রশ্রয় দিয়ে তাঁরা সন্তানদের মানুষ করেন। তাঁদের প্রত্যাশা সন্তান যেন সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক জীবন যাপন করে। নিজ স্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই আশাকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে দরকার পরিবারে বন্ধুসুলভ পরিবেশ। যেখানে খোলামেলা কথা বলা যাবে। প্রত্যেকের প্রাপ্য সম্মান পাওয়ার অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা করতে হবে। অবশ্য তা সব সময় সম্ভব নয়। তাই অন্য পথ খোলা রাখতে হবে, যেখানে আলোচনার মাধ্যমে দূরত্বগুলো ঘোচানো সম্ভব হতে পারে।
সন্তান বড় হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। সংসার করবে। এই পরিবর্তনকে মা-বাবা দুজনেরই মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করে নিতে হবে আগে থেকেই। সংসার খরচের জন্য প্রয়োজনে অবশ্যই ছেলেমেয়ের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। মনে মনে কষ্ট নিয়ে অভিমান করে বসে থাকলে চলবে না। সংসারে নতুন অংশীদার হিসেবে ছেলের বউ, মেয়ের জামাইয়ের সহ অবস্থানকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। কাউকে ছোট করা বা হেয় করার প্রবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তবেই না এত দিনের পরিশ্রম সার্থক হবে। নতুবা মানসিক দূরত্ব বাড়তেই থাকবে। যা শত চেষ্টা করলেও পরে ঠিক হওয়ার নয়। সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ।
হলিউডের চিরসবুজ অভিনেত্রী সুসান সারানডেনের (জন্ম ১৯৪৬) একটা সদুপদেশ পড়েছিলাম এ বিষয়ে। তিনি বলছেন, সন্তানকে ভালোবাসার পাশাপাশি তাকে নিজেকেও ভালোবাসতে শেখাতে হবে। নিজেকে ভালো না বাসলে কেমন করে অন্যকে ভালোবাসবে। শুধু মা-বাবা নয়, তাকে অন্যদেরও ভালোবাসতে শেখাতে হবে। জীবনের সহজ-কঠিন, আনন্দ-বিষাদ, সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চলতে শেখাতে হবে।
সন্তানের যা ভেবে দেখা উচিত
সন্তানদের জন্য মা-বাবা সব সময় ভরসাস্থল। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সুপরামর্শ, বিভিন্ন রকমের সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তাঁরাই। তাই তাঁদের সুযোগ-সুবিধা দেখার দায়িত্ব কিন্তু সন্তানদেরই। একাধিক ভাইবোন থাকলে মা-বাবার দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে মিলিত উদ্যোগ দরকার। সেই ভাগাভাগি যেন কারও ওপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া না হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে বাবা-মাকেই। সন্তানদের মধ্যে যেন ভালো সমঝোতা থাকে, সে ব্যাপারে তাঁদের সতর্ক থাকতে হবে।
সন্তানকে মনে রাখতে হবে মা-বাবার সঙ্গে নানা কারণে মতভিন্নতা হতে পারে। বর্তমান সময়ে যা চল, আগের দিনে তা হয়তো ছিল অচল। বোঝাপড়ার এই দূরত্ব আলাপ-আলোচনায় মিটিয়ে নেওয়া সম্ভব। আলোচনা হচ্ছে সেই মোক্ষম ওষুধ, যা মনের জটিলতা ঘোচায়। নিরসন করে। মুখ দেখাদেখি বন্ধ, কথা বন্ধ কখনো কল্যাণকর নয়।
গীতিকার ও মনোবিশ্লেষক সুদীপ কুমার মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শ এখানে বেশ জুতসই মনে হচ্ছে। তিনি বলছেন, ‘পুত্র-কন্যাকে ভালোবাসুন। উজাড় করে ভালোবাসুন। কিন্তু অবশ্যই বেখেয়াল হবেন না। ভালোবাসার আতিশয্যে স্নেহান্ধ হবেন না। মা-বাবাকে অবশ্যই শ্রদ্ধা করবেন। এ কাজে কখনো বিবেকবিমুখ হোয়ো না।’
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।