সন্তানের হাতে কখন কোন প্রযুক্তি?

কমবয়সী সন্তানের ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় মা বা বাবার পাশে থাকা উচিত। মডেল: নাজিয়া ও শামায়েল। ছবি: সুমন ইউসুফ
কমবয়সী সন্তানের ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় মা বা বাবার পাশে থাকা উচিত। মডেল: নাজিয়া ও শামায়েল। ছবি: সুমন ইউসুফ

প্রযুক্তির বাইরে থাকা এ মুহূর্তে এককথায় অসম্ভব। তা সে শিশুই হোক কিংবা পরিণত বয়সের মানুষই হোক। মোবাইল ফোন, ট্যাবের মতো যন্ত্র নির্দিষ্ট বয়সের আগে সন্তানের হাতে তুলে না দেওয়াই ভালো। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপও নির্দিষ্ট বয়সের পর ব্যবহার করতে দিতে হবে। তবে মা–বাবাদেরই আগে থেকে জানা উচিত প্রযুক্তির ভালো–মন্দ দুটি দিক।

টিভি বিজ্ঞাপন না দেখিয়ে অনেক মা বাচ্চাদের খাওয়াতে পারছেন না—এমন কথা ১০-১২ বছর আগে পর্যন্ত শোনা যেত | কিন্তু টিভি বিজ্ঞাপনের এই নির্ভরতা নিয়ে অভিভাবকদের কখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে দেখা যায়নি | এর একটি কারণ হয়তো টিভি বিজ্ঞাপন হলো একমুখী যোগাযোগ (ওয়ান ওয়ে কমিউনিকেশন)।
আজকের প্রেক্ষাপট নিয়ে যদি কথা বলি, তবে দেখা যাবে ছয় মাসের বাচ্চা থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ এই মুহূর্তে কোনো না কোনো পর্দার দিকে তাকিয়ে জীবনের অন্য কাজগুলো করছে | সেটা হতে পারে মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ কম্পিউটার বা টিভি পর্দা। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে অভিভাবকদের করণীয় কী হওয়া উচিত তা আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না। কেননা অভিভাবকদের জন্য প্রযুক্তির এই জগৎ পুরোটাই নতুন।
নিজেদের জানার জগৎ সীমিত থাকলে সন্তানকে সঠিক নির্দেশনা দিতে গিয়ে ভুল হয়ে যেতেই পারে।
আগে যেখানে আমরা একটি টিভি চ্যানেল দেখে বড় হয়েছি, সেখানে এসেছে দেশি-বিদেশি হাজার হাজার চ্যানেল। আকাশ সংস্কৃতি খুলে দেওয়ায় দেশ, সংস্কৃতি, জাতিগত বিশেষত্বের চেয়েও গুরুত্ব পাচ্ছে ভিনদেশি প্রথা ও সংস্কৃতি। শুধু শিশুরা নয়, বড়দের জীবনযাপন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে টিভি ইন্টারনেট আর মোবাইল ফোন দিয়ে। এখন যোগাযোগ, তথ্য, বিনোদন, শিক্ষা—এককথায় সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তির মাধ্যমে। অবশ্যই ভালো দিক আছে প্রযুক্তির কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সবকিছুরই সীমানা নির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রয়োজন জেনে নেওয়া প্রযুক্তির নেতিবাচক দিক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব।
প্রযুক্তি কিছুটা হলেও অনেকের জীবন সহজ করেছে, আবার প্রযুক্তিভীতি, অনভ্যাসের কারণে অনেকের জীবনকে করেছে কঠিন। শিশু আধো আধো বোল থেকে শুরু করে পরিপূর্ণ শব্দ বা বাক্য শিখছে ট্যাব বা মোবাইল ফোন থেকে। এত কম বয়সে যখন মায়ের চোখে চোখ রেখে শব্দ বা বাক্য শেখার কথা, তখন তা চলে গেছে প্রযুক্তির দখলে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এতে মায়ের জীবন সহজ হয়েছে। কিন্তু শিশু তার আশপাশের পরিবেশ, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের আদান-প্রদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চোখে তাকিয়ে কথা বলা শিখছে না তারা। এটা কিন্তু অটিজমসহ অনেক অসুখের লক্ষণ। এমনও দেখা যায় শিশু অটিজমে আক্রান্ত নয় কিন্তু ট্যাব, স্মার্টফোননির্ভর জীবন আর পারিপার্শ্বিকতা থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়ার বিভিন্ন লক্ষণ নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে। তাই শিশুর হাতে প্রযুক্তি তুলে দেওয়ার আগে এর সময়সীমা ও ব্যবহারের পরিকল্পনা খুব জরুরি।
আজকাল বাচ্চারা ট্যাবে বা স্মার্টফোনে অনেক বেশি ভিডিও দেখে, কার্টুন দেখে—এটাই তাদের জীবন। এসব বাচ্চার একটি ভিডিও শেষ না করে অন্যটিতে যাওয়ার প্রবণতা বেশ কমন। এই অভ্যাস থেকে তারা দেখে অনেক কিছু, কোনো কিছুতে ফোকাস করতে শেখে না। যা তার পরবর্তী জীবনে ভয়াবহ পরিণতি তৈরি করতে পারে। কোনো একটি কাজ শুরু করে শেষ না করার প্রবণতাও তৈরি হয়। তাই ট্যাব ব্যবহার করে কী ধরনের কনটেন্ট সে দেখছে—ওটা থেকে বাচ্চা কী শিখবে তা ঠিক করা প্রয়োজন।
প্রযুক্তি শুধু শিশুদের না বড়দের জীবনও পাল্টে দিয়েছে। তাই নিয়ম করে প্রযুক্তিহীন কর্মকাণ্ডে থাকা—পারিবারিকভাবে যেমন গল্প করা, বই পড়া, বেড়াতে যাওয়া, বিভিন্ন খেলাধুলা নিয়ম করে করা খুবই প্রয়োজনীয়। ‘আমি জানি না’ বা ‘আমি পারব না’ বলে মায়েদের প্রযুক্তি থেকে দূরে থাকার বিষয়ও মোটেই ঠিক নয়। টিনএজ বয়সের শিশু-কিশোরদের প্রযুক্তি আগের চেয়ে অনেক বেশি শেখার সুযোগ দিয়েছে, পাশাপাশি এটাও জানা কথা মাত্রাতিরিক্ত কিছুই কখনো মঙ্গল বয়ে আনে না। তাই শিশুদের মোবাইল ফোন, ফেসবুক, স্নাপচ্যাট, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম ব্যবহারের নির্দিষ্ট যে বয়স দেওয়া আছে সে বয়সের পরেই ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত। এর মাধ্যমে শিশু কিন্তু নৈতিকতার চর্চাও শিখবে। শিশুর বয়স ১৩ বছরের বেশি দেখানো কোনো কঠিন কাজ না। কিন্তু এটা যে করা উচিত না তা শিশুকে বোঝাতে হবে নির্দিষ্ট বয়সের আগে। এসব মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট না করাই ভালো এবং নিয়ম ভেঙে কাজ করা অনৈতিক। একইভাবে সঠিক বয়সে ই-মেইল অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া উচিত। ই-মেইল আইডি ব্যবহার করেই বেশির ভাগ অনলাইন মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট করতে হয়, তাই আপনার শিশুর কয়টা ই-মেইল অ্যাকাউন্ট আছে তা আপনার জানা থাকা প্রয়োজন। তাদের ই-মেইলের রেফারেন্স ই-মেইলটি আপনার হওয়া জরুরি। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে বাচ্চার ই-মেইল অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টে অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণ থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।

কোনো অছিলাতেই শিশুর হাতে এভাবে ট্যাব তুলে দেওয়া ঠিক নয়
কোনো অছিলাতেই শিশুর হাতে এভাবে ট্যাব তুলে দেওয়া ঠিক নয়

ইন্টারনেটের নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ওয়েবসাইট ব্যবহার, এমনকি গেম খেলার আগে ভালো করে বাচ্চাদের জানাতে হবে যে তাদের করণীয় কী। দিনে কতটা সময় ব্যবহার করতে পারবে, এসব সাইটের কোন কোন জিনিস থেকে বাচ্চা কী শিখতে পারে, কোন কোন কাজ একেবারেই করা যাবে না, কী ধরনের ছবি দেওয়া যাবে, কাদের বন্ধু হিসেবে অ্যাড করা যাবে, এ রকম কিছু বিষয় জানাতে হবে।
মোবাইল ফোন আমাদের নিত্যদিনের অপরিহার্য একটি সঙ্গী। কিন্তু কোন বয়সে শিশু একটা ফোন পেতে পারে? ফোনে কী পরিমাণ টাকা বরাদ্দ থাকবে—এসব সম্পূর্ণ অভিভাবকের সিদ্ধান্ত। পারিপার্শ্বিকতা ও প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু মোবাইল ফোনে কথা বলা ছাড়াও ফোন দিয়ে ছবি তোলা বা ভিডিও করা যায়। প্রযুক্তিগত এসব সুবিধা ব্যবহারে সাবধানতা ও সচেতনতা প্রয়োজন। হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারের মাধ্যমে যোগাযোগ কার সঙ্গে করা যাবে, কতটুকু করা যাবে, ভিডিও কল করা যাবে কি না—এসব ব্যাপারে অভিভাবক ও বাচ্চাদের ধারণা থাকা প্রয়োজন। ছবি বা ভিডিও পাঠানোর ক্ষেত্রেও যে সচেতন থাকতে হবে তা অভিভাবক বাচ্চাকে বুঝিয়ে দেবেন।
ইন্টারনেট বিশাল তথ্যের ভান্ডার কিন্তু এই ইন্টারনেটে পাওয়া সব তথ্য কি ঠিক? কী করে বুঝব কোনটি ঠিক, কোনটি ভুল? এ ব্যাপারে অভিভাবক ও শিক্ষকের ভূমিকাই আসল। জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজন। বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়মিত বিভিন্ন বিষয় আলাপ করা দরকার। খুবই সাধারণ গল্পে ঢুকে কোন অবস্থায় কী করা ঠিক তা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। সন্তানের ওপর আপনার আস্থার বিষয়টি তাকে বুঝিয়ে বলুন, তার সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলুন।
এক ক্লিকেই গুগল একটি বিষয়ের অনেক তথ্য হাজির করে, আগেকার দিনে এই তথ্য জোগাড় করতে হয়তো অসংখ্য বই পড়তে হতো। কিন্তু এই এক ক্লিকের জামানায় সঠিক তথ্য পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য জেনে নিতে হবে করণীয়। শেখানো ও মনিটরিংয়ের জন্য অভিভাবক, শিক্ষক সবাইকে পরিচিত হতে হবে এসবের সঙ্গে। তাই অভিভাবকদের বিশেষভাবে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
প্রযুক্তি থেকে কাউকে এখন তো আর দূরে রাখা যাবে না, ঠিকও হবে না। তাই সবাইকে তৈরি হতে হবে প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীর জন্য। প্রস্তুতিই পারে আমাদের প্রযুক্তিনির্ভর একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দিতে।

লেখক: তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা