
বিথী ও সুজনের (ছদ্মনাম) ১০ বছরের বিবাহিত জীবনের বিচ্ছেদ ঘটে কিছুদিন আগে। নিজেদের সম্মতিতে তালাক হয়। তাদের দুজন ছেলে রয়েছে। প্রথম সন্তানের বয়স সাত এবং ছোট জনের তিন বছর। তালাক কার্যকর হওয়ার কয়েক মাস আগ থেকেই বিথী সন্তানদের নিয়ে আলাদা বাসায় থাকছেন। তালাক কার্যকর হলেও তাঁদের মধ্যে সন্তানদের বিষয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি। সুজন এখন সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে চান। এ বিষয়ে বিথীকে জানালেও বিথী সুজনকে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। কিন্তু বাবা হিসেবে সুজনের মন অস্থির হয়ে ওঠে সন্তানদের দেখার জন্য। কিন্তু বিথী কিছুতেই দেখা করতে দিচ্ছেন না। সুজন অনেকবার পারিবারিক পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার জন্য বসতে চাইলেও বিথীর অভিযোগ, সুজন একবার তাঁর সন্তানদের নিয়ে গেলে আর কোনো দিন ফেরত দিতে চাইবেন না। কিন্তু সুজনও তাঁর সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে চান। উপায় কী?
আইনে কী করা আছে?
আইন অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও সন্তানদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা আরোপ করেনি। বিচ্ছেদের পর সন্তান যাঁর কাছেই থাকুক না কেন, মা বা বাবার দুজনেরই সমান অধিকার রয়েছে তাঁদের সন্তানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার। তবে সন্তানদের হেফাজতে নেওয়া এবং অভিভাবক নিয়োগ হওয়া নিয়ে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। এমন যদি হয় তালাকের পর সন্তানদের দেখা করতে কোনো পক্ষ দিচ্ছে না, তাহলে একমাত্র উপায় হচ্ছে পারিবারিক আদালতের আশ্রয় নেওয়া। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের ১৬ক ধারায় আদালতের কাছে তাঁর সন্তানদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার জন্য আবেদন করা যায়। অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইনের ১২ ধারা অনুযায়ীও এ সুযোগ রয়েছে। তবে এ ধারায় সরাসরি আবেদন করা যাবে না। প্রথমে পারিবারিক আদালতে সন্তানদের হেফাজত কিংবা অভিভাবক হওয়া নিয়ে একটি মোকদ্দমা করে নিতে হবে। মূল মোকদ্দমার সঙ্গে এ আবেদন করতে হবে। এ আবেদন যে বাদী করতে পারেন তা নয়। বিবাদী অর্থাৎ যাঁর বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করা হয়েছে, তিনিও আবেদন করতে পারেন। সাধারণত এ ধরনের আবেদন করা হলে আদালত শুনানি শেষে অন্য পক্ষকে একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে সন্তানদের দেখাশোনা করার অনুমতি দিতে পারেন। তবে আদালত এ ক্ষেত্রে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে থাকেন। তবে সন্তানদের মঙ্গলের বিষয়টি আদালত সবচেয়ে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আদালত তখন প্রয়োজন মনে করলে কোনো পক্ষকে সময় বেঁধে দিতে পারেন সন্তানদের সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে।
মনে রাখতে হবে, অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন অনুযায়ী মুসলমানদের ক্ষেত্রে ছেলেসন্তান সাত বছর পর্যন্ত এবং মেয়েসন্তান বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকতে পারবে। তবে বাবাই হবে আইনগত অভিভাবক এবং সন্তান যাঁর হেফাজতেই থাকুক না কেন, বাবাকে সন্তানদের ভরণপোষণ দিয়ে যেতে হবে। যদিও সন্তানদের মঙ্গলের বিষয়টি এখানে প্রাধান্য পায়।
যা করা উচিত
সন্তানের সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে কোনো বিরোধ হলে দুজনকেই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে নেওয়া ভালো। নইলে বিরোধটি নিয়ে আদালতে গেলে এতে সন্তানের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এতে সন্তানদের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। অনেক সময় আদালত সন্তানদের কথা শুনতে চান। অনেক সন্তান মা বা বাবার প্রতি দুর্বল থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে সন্তানদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্রয়োজনে সন্তানকে দেখা করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নিজেরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করে নেওয়া যেতে পারে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট