সবাই তাকে ডাকেন ‘ফয়সালের আব্বা’

আম্মার চেয়ে আব্বা আমাদের বেশি আদর করতেন। আম্মা বেঁচে থাকলে কথাটা শুনে হয়তো একটু অভিমান করতেন। বড় সন্তান হওয়ার কারণেই কি না, আব্বা আমাকে সবচেয়ে বেশি স্নেহ করেছেন। আম্মার মৃত্যুর পর সেই স্নেহ, মায়া-মমতা দ্বিগুণ হয়েছে। পরিবারের সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্তে আমাদের মা-বাবা দুটিই হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বড় সমুদ্র বিশাল পাহাড়ের সঙ্গে যেভাবে লেগে থাকে, আমাদের আব্বা তেমন হয়ে উঠলেন। মায়া-মমতায় তিনি সমুদ্রের চেয়েও গভীর, আবার পরিবারের সবাইকে ছায়ায় রেখে তিনি বিরাট পর্বত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার অন্য ভাই-বোনদের বেলায় কী ঘটেছে জানি না, তবে আমার জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় আব্বা সব সময় পাশে ছিলেন। আজও আছেন।

আব্বার অফিস আর আমাদের বাসা পাশাপাশি ছিল। শৈশবে আইসক্রিমওয়ালা ঘণ্টা বাজিয়ে বাসার সামনে এলেই খালি গায়ে আব্বার অফিসে দৌড় দিতাম। দুই টাকার জন্য আব্বার কাছে বায়না ধরতাম। আব্বার সহকর্মীরা মুচকি হাসতেন, আর আব্বা ঘটর–ঘটর করে টাইপরাইটারে লিখতেন।

বড় সন্তান হওয়ার নানা কষ্ট থাকলেও একটা বিষয় আমাকে বেশ আনন্দ দেয়। সেটা হলো, মা-বাবা পরিচিত মহলে বড় সন্তানের নামে ডাক শোনেন। যেমন আমার আব্বার নাম হাবিবুর রহমান, কিন্তু সবাই তাকে ডাকেন ‘ফয়সালের আব্বা’। আমার ডাকনাম ফয়সাল। আমার ছোট চার ভাই-বোন এ আনন্দ থেকে বঞ্চিত।

সন্তানদের সঙ্গে ‘ফয়সালের আব্বা’ হাবিবুর রহমান
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আব্বাকে ঘিরে আমার আরও কিছু নিজস্ব ভালো লাগার কারণ আছে। জ্বর বা কোনো কারণে গা গরম হলেই আমি একটা ঠান্ডা হাত ধরতে চাইতাম। ছোটবেলা অসুখ হলেই বিছানা ছেড়ে সোজা গিয়ে আব্বার কোলে চড়তাম। জানি না আব্বার শরীরে কী আছে, জ্বরে ওটা আমাকে শান্তি দিত। একবার ক্লাস টেনে প্রচণ্ড জ্বর, তখন তো আমার হাত-পা একটু লম্বা হয়ে গেছে, শরীর ভারী হয়ে এসেছে, তবু আমি বায়না ধরলাম, ‘আব্বা কোলে নেও।’ হাসতে হাসতে আব্বা কোলে নিলেন, আর বললেন, ‘আমার পাগলা ব্যাডা, আমার বুইড়া ব্যাডা।’

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লেখক (সর্বডানে)

আব্বার নানা বদভ্যাস আমি পেয়েছি; যেমন বেহিসেবি জীবন। আব্বা কোনো দিন গুনে গুনে কথা বলেন না। মনের আনন্দে, হাসিঠাট্টা করে জীবনটা কাটিয়ে দিলেন। আমিও বোধ হয় তেমন। তিনি যাকে পছন্দ করেন, একেবারে হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসেন। বদভ্যাস বলছি এই কারণে, এ ধরনের মানুষ ঠকে বেশি। লোকে সহজ-সরল ভেবে কষ্ট দেয়। আব্বার বন্ধুদের আমি লুকিয়ে লুকিয়ে জিজ্ঞেস করেছি, আমার আব্বা কেমন? প্রত্যেকেই প্রায় একই রকম উত্তর দিয়েছেন, তিনি বেশ আমুদে মানুষ।

বয়স বাড়ার আনন্দের চেয়ে বেদনা বেশি। দিন দিন বন্ধুর সংখ্যা কমতে থাকে, পরিবারের সঙ্গেও সব দুঃখ-কষ্ট শেয়ার করা যায় না। ছোটবেলা থেকে আব্বা এক রকমের শাসনে বড় করেছেন আমাদের। তবু যখন কোনো বিপদে পড়ি, আব্বাই সবার আগে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন। আমার ও আমার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের বটবৃক্ষ আমার আব্বা। তিনি আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল।