সব পরিচিতি ফলক (সাইন বোর্ড) বাংলায় হবে—উচ্চ আদালত এই নির্দেশনা দেন তিন বছর আগে। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরের বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইন বোর্ড এখনো বাংলায় হয়নি। বিশেষ করে দোকানপাটে ইংরেজিতে লেখা সাইন বোর্ড চোখে পড়ে অহরহ। নগরে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল সিটি করপোরেশনের।
অবশ্য সিটি করপোরেশন বলছে, সাইন বোর্ড বাংলায় রূপান্তর করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে রাজস্ব বিভাগ। প্রয়োজনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করার চিন্তাভাবনা রয়েছে করপোরেশনের।
উচ্চ আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর উদ্যোগ কম বলে মন্তব্য করেছেন ভাষাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদেরা। তাঁরা বলছেন, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো পদক্ষেপ নিলে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।
২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক আদেশে দেশের সব সাইন বোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেট, সরকারি দপ্তরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেন।
আদালতের আদেশের তিন মাস পর ২০১৪ সালের ১৪ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোকে আদেশটি কার্যকর করতে বলে। কিন্তু তা না হওয়ায় ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট আদালত কড়া ভাষায় মন্তব্য করেন, বাংলা ব্যবহারে দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই। পরে ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক চিঠির মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে সাইন বোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেটে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার অনুরোধ জানায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়, সাইন বোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইংরেজির স্থলে বাংলায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে বলে দেখা যায় না। এটা বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, হাইকোর্টের রুল ও আদেশের পরিপন্থী।
নগরের অক্সিজেন, হামজারবাগ, মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট, প্রবর্তক মোড়, চকবাজার, মোমিন রোড, জামালখান, লাভ লেন, কাজীর দেউড়ি ও আন্দরকিল্লা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কিছু প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা। অনেক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাই রয়েছে। আর কিছু প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা।
নগরের মোমিন রোডে উপহারসামগ্রীর দোকান ‘স্বপ্নবাজ’–এর সাইনবোর্ড লেখা আছে ইংরেজিতে। এর আশপাশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড অবশ্য বাংলায় দেখা যায়। গত মঙ্গলবার বিকেলে দোকানে থাকা স্বপ্নবাজের বিক্রয়কর্মী মোহাম্মদ মারুফ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি তাঁদের জানা নেই। এখন জানতে পেরেছেন। দ্রুত বাংলায় রূপান্তর করা হবে।
অবশ্য আগের তুলনায় দোকান ও প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ও ব্যানার বাংলায় লেখার হার বেড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নগরের লাভ লেন এলাকার মদিনা আর্টের স্বত্বাধিকারী মো. আনোয়ার উল্লাহ। প্রায় ৪০ বছর ধরে ব্যানার ও সাইনবোর্ড লেখার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তিনি। প্রথম আলোকে বলেন, বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার ব্যাপারে সরকারের চাপ রয়েছে। এ ছাড়া মানুষের মধ্যেও সচেতনতা বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (চলতি দায়িত্ব) ও ভাষাবিজ্ঞানী মাহবুবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পরিচিতি ফলকে বাংলা ব্যবহারে উচ্চ আদালতের নির্দেশ আছে। এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগ কম। সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নিলে তা বাস্তবায়ন করা সহজ হবে। অবশ্য সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে জনগণের মধ্যেও আগ্রহ ও সচেতনতা থাকতে হবে।
সব সাইনবোর্ডে পুরোপুরি বাংলার ব্যবহার না হওয়া নিজেদের মানসিকতাকে দায়ী করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও গবেষক ভূঁইয়া ইকবাল। তিনি বলেন, বাংলায় সাইনবোর্ড লিখতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনে বাধ্য করতে হবে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নগরের সব সাইনবোর্ড বাংলা ভাষায় রূপান্তর করার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে চলতি মাসের ৫ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞপ্তি দেয়। এতে ৩০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ইংরেজি লেখা সাইনবোর্ড চিহ্নিত করার জন্য কর কর্মকর্তা ও লাইসেন্স পরিদর্শকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের চিঠিও দেওয়া হবে। আর এখন যাঁরা নতুন ট্রেড লাইসেন্স করছেন, তাঁদের বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার ব্যাপারে বলে দেওয়া হচ্ছে।