সব বদলেই মানিয়ে নেওয়া

ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে অভ্যাস, তাঁকেই ব্যবহার করতে হচ্ছে সিএনজি অটোরিকশা। করোনাকালের বদলে যাওয়া পরিস্থিতি মেনে চলতে হচ্ছে অনেককে। প্রতীকী এই ছবিতে মডেল হয়েছেন রিয়াদ।ছবি: সুমন ইউসুফ

রাজধানীর ছোট ছোট এলাকার কোনো একটা গলিতে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে অসংখ্য ‘টু-লেট’ লেখা সাইনবোর্ড। গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর গেটে, জানালায়, দরজায় টাঙানো ‘বাড়িভাড়া’ নোটিশটা যেন বড্ড বিষণ্ন করে দেয়। বোঝা যায় করোনাভাইরাসের কারণে গত ৯ মাসে কাজ হারিয়ে শহর ছেড়েছেন অনেক মানুষ।

এ যেন কাল্পনিক গল্প নিয়ে লেখা কোনো সিনেমা। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে, ঘরবন্দী থাকতে হচ্ছে মানুষকে। আয় গেছে কমে, কারও আয় শূন্য। একসময় বেঁচে থাকার তাগিদে শহর ছেড়ে অজানার পথে চলা। করোনার এই সময়ে জীবন আগে না জীবিকা আগে, এ প্রশ্ন যেন মাথায় পেরেক ঠুকেছে সবার। ছোট্ট বাড়ি দিয়ে হাতুড়ি একবার বলে, জীবন বাঁচাও, একবার বলে জীবিকা। কাকে এগিয়ে রাখা যায় তার কি উত্তর মেলে? জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাড়িতে থেকে যখন সব সঞ্চয় শেষ হয়, তখন তো আঘাত আসে আরেক দিক থেকে।

দুঃসময়ের খড়্গ

বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনা এ বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তকে প্রভাবিত করেছে ধনী-দরিদ্র সবাইকে। মাঝখানে যে মধ্যবিত্ত তার ওপর প্রভাবটা যেন আরও তীব্র। সীমিত আয়ে যাদের জীবন যাপন করতে হয়। মাস শেষে বাড়িভাড়া, বাজার খরচ, সন্তানদের স্কুলের বেতন, আনুষঙ্গিক আরও অনেক খাতে খরচ করতে হয়। কোনো কারণে পাঁচ-সাত দিন আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হলেই এমন পরিবারগুলোতে নেমে আসে দুঃসময়। কথা হয় এমনই কজনের সঙ্গে।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রানু বেগম। তাঁর স্বামী সুমন একটি এনজিওতে কাজ করতেন। চাকরি চলে যাওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী মিলে একটি স্কুলের সামনে ছোট্ট একটি কাপড়ের দোকান খোলেন। যা আয় হচ্ছিল, তা দিয়ে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা এই দম্পতির দুই সন্তান নিয়ে ভালোই চলছিল। হঠাৎ করে করোনার কারণে সব ওলটপালট হয়ে গেল। রানু বেগম বলেন, স্কুল বন্ধ থাকায় বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে একদম। জুন মাসের দিকে অনলাইনে বিক্রি শুরু করি। তবে আয় আগের চেয়ে কম। ছোট্ট ছোট্ট সব শখই বাদ দিয়েছি জীবন থেকে। নিজে কষ্ট করা যায়। তবে ছেলেমেয়ের জন্য কষ্ট হয়। ছোট মানুষ প্রায়ই ভালো কিছু খাওয়ার আবদার করে, দিতে পারি না, কষ্ট হয়। আগে সুযোগ পেলেই বাচ্চাদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যেতাম।

এমন কষ্ট পেয়েছিলেন শরিফুল আলমও। ঢাকায় ছোট একটা বাসা ভাড়া করে থাকতেন, চাকরি ছিল একটি পর্যটন প্রতিষ্ঠানে। স্ত্রী আর আট বছরের মেয়েকে নিয়ে ভালোই চলছিল। করোনায় কাজ হারালেন। ঢাকায় থাকার ব্যয় মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। গ্রামের বাড়িতে থাকা মা-বাবা পরামর্শ দেন সেখানে চলে যেতে। সব ছেড়ে সেপ্টেম্বরে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন তাঁরা। শরিফুল জানান, তাঁর মেয়ে স্কুল ছেড়ে দিতে হচ্ছে বলে খুব কেঁদেছিল।

কমেছে গড় আয়

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, কোভিড-১৯-এর কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হওয়ায় পরিবারগুলোর গড় আয় কমেছে ২০ শতাংশ। গত মার্চে প্রতি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্ট মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৪৯২ টাকায়। এই ৪০০০ টাকার ব্যবধান একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য অনেক। তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে পরিবার চালাতে। প্রয়োজনটাই আগে, এমন প্রাধান্য দিয়ে কাঁচি চলছে সব শখে।

বাসাভাড়া দিতে না পেরে ঢাকা ছাড়া, বড় বাসা ছেড়ে ছোট বাসায় যাওয়া, প্রয়োজন না হলে কাপড়চোপড় না কেনা, বাড়িতে টাকা পাঠানো বন্ধ, হুট করে অল্প টাকায় সংসার চালানো—এমন সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মানসিক টানাপোড়েন। সোমা কবির একটি কোম্পানিতে নির্বাহীর কাজ করতেন, করোনার কারণে গত এপ্রিলে চাকরিটা চলে যায়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি। পারিবারিকভাবে তেমন অসচ্ছলতা নেই, তবে প্রয়োজনে স্বামীর কাছে টাকা চাওয়া, নিজের মতো খরচ করতে না পারা তাঁকে খানিকটা মানসিক কষ্ট দিচ্ছিল। অবশ্য এখন কিছুটা সামলে উঠে নতুন কিছু করার চেষ্টা করছেন তিনি।

সামলে নিতে হবে

সোমা কবিরের মতোই সবার নিজেদের সামলাতে হবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ একটি বৈশ্বিক সংকট। এই সংকটে আয় হারিয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের অসংখ্য মানুষ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বিশ্বব্যাপী শ্রম আয় সাড়ে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার কমেছে (১ ট্রিলিয়ন = ১ লাখ কোটি)। হঠাৎ করেই একটি নতুন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বিশ্বকে, যা আবার নতুন স্বাভাবিকের মতো মেনে নিতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেন, করোনার এই সময়ে বিশ্বের বহু দেশ যেখানে মন্দায় ডুবেছে, সেখানে বাংলাদেশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারায় রয়েছে। গতি ধীর হলেও সামনের দিকে হাঁটছে। সেই হিসাবে বড় রকমের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়েনি। তবে টিকে থাকার সংগ্রামে সার্বিক অর্থনীতির কিছু আঁধার থাকেই। সেদিকে আসলে সরকারি পর্যায়ে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। বিষয়টি হচ্ছে করোনার এই সময় অনেকে কাজ হারিয়েছেন, অনেকের আয় কমেছে, যার অন্যতম কারণ চাহিদা-সংকট। উৎপাদন-সংকটের কারণে এমনটা হয়নি। ধীরে ধীরে সেটি কাটছে। স্বাস্থ্যবিধি মানার চলমান অভ্যাসটা ধরে রেখে মানুষ যদি কাজ শুরু করেন, তবে এর মধ্যেও ভালো থাকা সম্ভব হবে। এ ছাড়া ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন বা যাঁদের আয় কমেছে, তাঁরা যেন নতুন কিছু করতে পারেন, সে দিকে সরকারি পর্যায়ে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।

তবে এই পরিস্থিতিতে একটা আয়েশি জীবন থেকে হঠাৎ পতনের ফলে অনেকেই দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। বছরের পর বছর যে পরিবারের ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ার অভ্যাস, হুট করে সেই গাড়ি বিক্রি করে গণপরিবহনে চড়া তো তাঁর জন্য খানিকটা কঠিনই। তবে এসব মেনেই এগিয়ে চলার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। জীবনে উত্থান-পতন থাকবেই, তার মধ্যেও ভালো থাকার চেষ্টা করতে হবে।

বাড়ির ছোটদের বোঝাতে হবে, এই পরিস্থিতি হয়তো কেটে যাবে। এখন যা আছে, তা-ই নিয়ে ভালো থাকার নামই জীবন।