ভাই-বোনের সম্পর্কই সবচেয়ে মধুর। তবে মাঝেমধ্যে এই সম্পর্কেও ফাটল দেখা দেয়। বিশেষ করে বাবা-মায়ের রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিয়ে প্রায়ই ভাই-বোনদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এসব মামলায় বোনদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘটনাই বেশি দেখা যায়। ভাইয়েরা ভেবে নেন বোনকে যেহেতু বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে বা হয়েছে, তাই বাবা কিংবা মায়ের সম্পত্তিতে তাঁদের আর কোনো অধিকার নেই। কিন্তু আইন কী বলে আসুন জেনে নিই।
কার কী অধিকার?
বাবা থাকা অবস্থায় মেয়ের বিয়ে না হয়ে থাকলে বাবার কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। বাবাকে ভরণপোষণ দিতে অন্য কেউ বাধা দিতে পারবেন না। বাবার অবর্তমানে অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তবয়স্ক কর্মহীন বোনদের ভরণপোষণ দেওয়া ভাইদের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। বাবা বা মা মারা গেলে বোনেরাও সম্পত্তির ভাগ পাবেন। কোনোভাবেই বোনদের বঞ্চিত করার কোনো সুযোগ নেই। আবার বোনেরাও উল্টো ভাইদের বঞ্চিত করতে পারবেন না।
মুসলিম আইনে বাবা বা মা মারা যাওয়ার পর তাঁর যদি ছেলে ও মেয়ে থাকে, তবে রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে ছেলে যা পাবেন, মেয়ে তার অর্ধেক পাবেন। অর্থাৎ ভাইয়েরা যা পাবেন তার অর্ধেক বোনদের বুঝিয়ে দিতে হবে। ইচ্ছা করলেই বোনদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এ সম্পত্তি বলতে ভূমি, বাড়িসহ ব্যাংকে রেখে যাওয়া টাকা এবং ফ্ল্যাটও বোঝায়। বোনদের বিয়ে হয়ে গেলেও বাবা বা মায়ের রেখে যাওয়া সম্পত্তির ভাগ তাঁদের দিতেই হবে। অনেক বোন হয়তো বাবার বাড়িতেই অবস্থান করতে পারেন; এমনকি বিয়ে হওয়ার পরও স্বামী, সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকতে পারেন। এ ক্ষেত্রে অনেক ভাই ভেবে থাকেন যেহেতু বোন বাড়িতেই আছেন, সে জন্য কোনো সম্পত্তি দেওয়া লাগবে না। এ ধারণা ঠিক নয়।
বাবা কাউকে ক্ষমতা দিয়ে থাকলে
অনেক সময় দেখা যায় বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় কাউকে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ দিয়ে তাঁর জমি বিক্রি বা হস্তান্তর করার দায়িত্ব দিয়েছেন। অনেক ভাই অজুহাত দেখান যে যেহেতু বাবা পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে গেছেন তাই বোনদের না জানিয়েই সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া যাবে। এ ধারণা ঠিক নয়। বাবার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ার অব অ্যাটর্নির আর কোনো ক্ষমতা থাকে না। তাই আইন অনুযায়ী ভাই ও বোনেরা সম্পত্তি পাবে। বাবা যদি কাউকে রেজিস্ট্রি মূলে দান করে দিয়ে থাকেন তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। এ ক্ষেত্রে কেউ কারও সম্পত্তি দাবি করতে পারবে না।
বিরোধের নিষ্পত্তি যেভাবে
কোনো বিরোধ ভাই-বোনেরা আলোচনা করে নিজেদের মধ্যে আপস করে নিতে পারেন। সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগবণ্টন করে বণ্টননামা সম্পন্ন করতে পারেন। এই বণ্টননামা রেজিস্ট্রি করে নিতে হবে। বণ্টননামা করার পর যার যার অংশের নামজারি করাতে হবে। যদি কেউ কাউকে সম্পত্তি দিতে না চান কিংবা সম্পত্তি কম দিতে চান তাহলে দেওয়ানি আদালতের আশ্রয় নিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত ব্যক্তিরা বাঁটোয়ারা বা বণ্টনের মোকদ্দমা করতে পারেন।
সাধারণত বিরোধ দেখা দেওয়ার ছয় বছরের মধ্যে আদালতে যেতে হয়। এই মোকদ্দমা চলাকালে কেউ মারা গেলে তাঁদের উত্তরাধিকারীরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন এবং অংশ চাইতে পারেন। এ মামলায় দুবার ডিক্রি হয়। প্রাথমিক ডিক্রির পর বণ্টন না করা হলে আদালত অ্যাডভোকেট কমিশনার নিয়োগ করে অংশ নির্ধারণ করে দিতে পারেন এবং চূড়ান্ত ডিক্রি প্রদান করেন। মামলা চলাকালীন আদালতের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কেউ কারও সম্পত্তি দখল করে নিতে বা দিতে না চাইলে স্বত্ব ঘোষণা ও দখলের মোকদ্দমা দায়ের করার সুযোগ রয়েছে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট