সর্বনাশা নেশা

লন্ডনে কোরাল দোকানের সামনের দৃশ্য।
লন্ডনে কোরাল দোকানের সামনের দৃশ্য।

লন্ডনে এসেছি প্রায় ছয় বছর হতে চলল। আসার পর আমার সবকিছুই ভালো লাগে। প্রথম দিকে প্রচুর অবসর সময়। বিভিন্ন স্থানে যাই, দেখি। তখন আমার মধ্যে অন্য রকম এক অনুভূতি।

কিছুদিন যাওয়ার পর একদিন আমার রুমমেট বলল, ‘এক জায়গায় যাবে?’ আমি জানতে চাইলাম, কোথায় নিয়ে যাবেন! তিনি বললেন, ‘ঘোড়ার ঘরে গেছো কোনো দিন?’ বললাম, যাইনি। আমি আগ্রহ প্রকাশ করলাম। কারণ আমি ভেবেছিলাম তিনি আমাকে সত্যি সত্যি ঘোড়াশাল দেখাবেন।

যদিও জীবজন্তু আমার পছন্দ নয় তেমন। কুকুরকে এখনো প্রচণ্ড ভয় পাই। তার পরও ভাবলাম, ঘোড়াশাল, তা-ও আবার লন্ডনে! তৈরি হয়ে নিলাম জলদি। তিনি আমাকে একটা হাইস্ট্রিটে নিয়ে গেলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কারণ এখানে আগে কয়েকবার এসেছি, ঘোড়াশাল দূরের কথা, ঘোড়াও চোখে পড়েনি।

রুমমেট আমাকে নিয়ে গেলেন একটা দোকানের সামনে। দোকানের নাম কোরাল। আমি প্রশ্ন করার আগেই তিনি আমাকে ঢুকিয়ে নিলেন ওখানে। দেখি সেটা ভিডিও গেমসের দোকান। যেটা বাংলাদেশে অলিগলিতে ছিল একসময়। কোথায় ঘোড়া, কোথায় কী!

রুমমেটকে বললাম, আমি গেমস খেলি না! তিনি বললেন, ‘চুপচাপ দেখো।’ আমি আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ দেখতে থাকলাম। আমি বাংলাদেশ থেকে আসার সময় যে পরিমাণ টাকা বাবা আমাকে দিয়েছিলেন, প্রায় সেই পরিমাণ টাকা রুমমেট একটা ভিডিও গেম মেশিনে ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর কিছুক্ষণ লাল রঙের একটা চাকতি ঘুরল। ভাবলাম, এটা পৃথিবীর সবচেয়ে দামি চাকতি নিশ্চয়ই। সেই আমার প্রথম ও শেষ যাওয়া সেখানে। বাংলাদেশের অনেকেই সেখানে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।

এ দেশে এটা লাইসেন্সধারী ব্যবসা। ১৮ বছরের ওপরে যে কেউ খেলতে পারেন। তাই সবাই কম-বেশি খেলেন। একটা সময় এটা অভ্যাসে পরিণত হয় আর অভ্যাস থেকে নেশা। মাদকের নেশা থেকে কোনো অংশে কম না। সমস্যা হলো, যুক্তরাজ্যপ্রবাসী কিছু বাংলাদেশির মধ্যে এই খেলার আগ্রহ প্রকট আকারে রয়েছে। অনেকের মাসের সব আয় চলে যায় এই মেশিনে। একপর্যায়ে তাঁরা হয়ে পড়েন অপ্রকৃতিস্থ। তাঁরা ভুলে যান দেশ ও মা-বাবার কথা, এমনকি নিজের ভবিষ্যতের কথাও। তাঁদের ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে থাকে এই খেলা। তাঁদের আচরণও অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা।

লন্ডনে একসময় একই ফ্ল্যাটে ছিলাম আমি ও মাসুদ ভাই। অত্যন্ত মিশুক ও আমুদে স্বভাবের। যাচ্ছেতাই ভাষায় কথা বলতেন। তবু ভালো লাগত। আমরা অনেকে তাঁর রুমে গিয়ে বসে থাকতাম। মধ্যবয়সী মাসুদ ভাই সারা দিন আমাদের সবাইকে নিয়ে আমোদ প্রমোদে ব্যস্ত। সবার জন্য তাঁর মন অনেক উদার।

আমি কারও ব্যক্তিগত বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখাতাম না। কিছুদিন পর জানতে পারি তাঁর স্ত্রী লন্ডনেই ছিলেন। ঝগড়া করে দেশে চলে গেছেন। তাঁদের ছেলেমেয়ে নেই। মাসুদ ভাইয়ের একাকিত্ব দেখে আমার মন খারাপ হতো। খুব মিশতাম তাঁর সঙ্গে। আস্তে আস্তে জানতে পারি তিনি বড় একটা কোম্পানির শাখা ব্যবস্থাপক। ভালো বেতন পান। তার পরও তাঁর প্রচুর ধারদেনা। কথাটা শুনে আমার খুব কষ্ট হলো।

এক সময় মাসুদ ভাই নিজে জানালেন, তাঁর দেনার পরিমাণটা। গত পাঁচ বছরে অত টাকা আমি সঞ্চয়ও করতে পারিনি। একটা কথা বলে রাখি, মাসুদ ভাই ঘোড়ার ঘরের একজন নিয়মিত খদ্দের। এখন বেচারা দেশে আছেন। শুনেছি তাঁর স্ত্রী তাঁকে ডিভোর্স দিয়েছেন। বাংলাদেশে গিয়ে মাসুদ ভাই নিজেকে যদি বদলে থেকে থাকেন, তাহলে ধরে নেওয়া যায় তিনি ভালো আছেন। কারণ শুনেছি, বাংলাদেশেও নাকি এমন আছে।

এবার আসি আরেক মজার মানুষের কথায়। তিনি নাসির ভাই। আমার সহকর্মী। লন্ডনে তাঁকে অনেকে চেনেন। কিছুটা বিখ্যাত। খুবই সরল, আবার খুবই অদ্ভুত আচরণ তাঁর। কখনো খুব অপ্রকৃতিস্থ, কখনো ভুলোমনা, আবার কখনো খুব স্বাভাবিক। কাজে খুবই ভুল করেন। আমরা সবাই মোটামুটি তাঁকে পছন্দ করি। তাই তাঁর ভুলটা কখনো আমরা গোপন করি, আবার কখনো তাঁর সঙ্গে এটা নিয়ে মজা করি। মাঝেমধ্যে এ সব নিয়ে বাড়াবাড়িও হয়। তবে তিনি কখনো কিছু মনে করেন না। এজন্যই তাঁকে আরও ভালো লাগে।

এই নাসির ভাইকে নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেল কিছুদিন আগে। তাঁকে নিয়ে অনেক অভিযোগ কাজের ব্যাপারে। এটা ভুলে যান, সেটা ভুলে যান। এ জন্য তাঁর চাকরিই চলে গেল। মানসিকভাবে এমন অপ্রকৃতিস্থ একটা মানুষ, তাই আমরা কেউ তাঁর ব্যাপারে সুপারিশও করলাম না। যদিও আমাদের সবার জানা, সুপারিশে কোনো কাজ হবে না।

যা-ই হোক, ফ্যাঁকড়া বাধল তাঁর বিদায় নেওয়ার সময়। সবাই যখন জানল তাঁর চাকরিচ্যুত হওয়ার বিষয়টি, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল অবিশ্বাস্য একটা তথ্য। সহকর্মীদের মধ্যে শুধু দুজনের কাছ থেকে তিনি ধার করেননি। বাকি সবার কাছ থেকেই তিনি টাকা ধার করেছেন।

নাসির ভাইকে আমি আলাদা করে নিয়ে জানতে চাইলাম, এতগুলো টাকা কোথায় গেল। তিনি ধীরে ধীরে তাঁর ঘোড়াপ্রীতির কথা জানালেন। জানা গেল, মাসুদ ভাইয়ের মতো তাঁরও সব হারানোর কথা। শুনে আমার খুব মায়া হলো। আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তি অর্থাত্ বসের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বললাম। তাঁকে জানালাম, নাসির ভাইয়ের কাছে একটি পয়সাও নেই। তিনি আমার কথা শুনে তাঁর প্রতি সদয় হয়েছেন। নাসির ভাই এখনো আমাদের সঙ্গে আছেন। কাজ করে ধারের সব টাকা শোধ করবেন। ঋণ মেটাতে লাগবে আরও পাঁচ মাস।

আমি এখনো ছাত্র। এ সূত্রে দেখেছি এ দেশে পড়তে আসা কিছু বাংলাদেশি ছাত্রকেও এই নেশায় জড়িয়ে পড়তে। এটা দেখে অসম্ভব কষ্ট হয়। একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নেই তো এই দেশে আসা এবং এত কষ্ট করা। তার পরও কেন বুঝেশুনে এই ভয়াবহ নেশার দিকে এগিয়ে যাওয়া। আজ পর্যন্ত অবশ্য আমি কাউকে বোঝাতে পারিনি, উল্টো তাঁরা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে কত নিরাপদ তাঁদের এই বিনিয়োগ!

মেরাজ মোরশেদ

লন্ডন, যুক্তরাজ্য