যে কারণে ক্লাবে যুক্ত হওয়া জরুরি
এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ বা সহশিক্ষা কার্যক্রমে কেন শিক্ষার্থীদের যুক্ত হওয়া উচিত, সে প্রসঙ্গে লিখেছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এবং ক্যারিয়ার ও প্লেসমেন্ট সেন্টারের পরিচালক খসরু মিঞা।
নতুন দক্ষতা রপ্ত করার সুযোগ
সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ক্লাব বা সংগঠনে যুক্ত হলে যোগাযোগের দক্ষতা তৈরি হয়, রিপোর্ট লেখা বা নিজের ভাবনা উপস্থাপনের কৌশল শেখা যায়। দলের সঙ্গে কাজ করা, নেতৃত্ব দেওয়া, এসব দক্ষতাও মানুষ ক্লাব থেকেই শেখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ক্লাব প্রোগ্রামিং, ফটোগ্রাফি, রোবটিকসের মতো কারিগরি দক্ষতার চর্চাও করে। যদি এসব বিষয়ে আগ্রহ থাকে, তাহলে এ ধরনের ক্লাবে অংশ নিয়ে সহজেই দক্ষতা রপ্ত করা যায়।
ক্লাসের পড়াশোনার মান ভালো হয়
ক্লাবে যুক্ত হলে ক্লাসরুমে আমরা যা শিখি, পেশাজীবনে প্রবেশের আগেই তা প্রয়োগের সুযোগ পাওয়া যায়। ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিভাগভিত্তিক ক্লাবও গড়ে উঠছে। যেমন আমাদের নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতেই আছে ফার্মাসি ক্লাব, মার্কেটিং ক্লাবের মতো নানা সংগঠন। সারা বছরই ক্লাবের সদস্যরা বিভিন্ন আয়োজনে যুক্ত থাকেন। এর মাধ্যমে তাঁরা যেমন পাঠ্যবইয়ে শেখা বিষয়গুলোর চর্চা করতে পারেন, তেমনি সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রি বা চাকরির বাজার সম্পর্কেও ধারণা পান। দলগত কার্যক্রমের মাধ্যমে বিকশিত হয় মনন, প্রফুল্ল থাকে মন, তাই পড়াশোনায়ও তৈরি হয় আগ্রহ। ক্লাসে মনোযোগ দিতে সুবিধা হয়। ব্যবহারিক দক্ষতা বিস্তৃত হয় বলে পরীক্ষা ও ক্লাস প্রেজেন্টেশন, রিপোর্ট-রাইটিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা বাড়ে, এতে পরীক্ষায় ভালো করার সুযোগ তৈরি হয়।
কারিগরি শিক্ষা ও কাজের অভিজ্ঞতা বাড়ে
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষা ও জানার পরিধি অনেক কম। সহশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কারিগরি জ্ঞান ও কাজের সুযোগ বাড়ে। যেমন বিবিএপড়ুয়া শিক্ষার্থী বিজনেস ক্লাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রোগ্রাম ডিজাইন, বাজেট তৈরিসহ বিভিন্ন বিষয় শিখতে পারেন। কলা অনুষদের ছাত্রছাত্রীরা আইটি ক্লাবে যুক্ত হয়ে কোডিং বা প্রোগ্রামিং শেখার সুযোগ নিতে পারেন। শুধু নিজের পড়ার বিষয়ে দক্ষতা থাকলেই হবে না, অন্য বিষয়েও ধারণা রাখা চাই। ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রে এ ধরনের অভিজ্ঞতা খুব জরুরি। ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও নিয়োগদাতা করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই চর্চাকে গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করে।
সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতার বিকাশ ঘটে
সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামাজিক জড়তা দূর হয়। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া, স্পষ্ট ভাষায় কথা বলাসহ যেকোনো বিষয়ে নিজের অবস্থান প্রকাশ করতে শেখে শিক্ষার্থীরা। এখনকার সময়ে এ দক্ষতা ভীষণ জরুরি। আর বিশ্ববিদ্যালয়জীবনই এসব শেখার সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু করোনার কারণে যেহেতু দীর্ঘদিন আমরা অনলাইন ক্লাসের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম, যোগাযোগ ও সামাজিকতার দক্ষতায় একটা বড় ঘাটতি তৈরি হয়ে গেছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ বা দ্বিতীয় বর্ষ পড়ছ, অফলাইনে ক্লাস করার অভিজ্ঞতা খুব বেশি পাওনি, দেরি না করে এখনই কোনো না কোনো ক্লাবে যুক্ত হয়ে যাও।
শেখা যায় সময় ব্যবস্থাপনা, কাজে আসে অবসর
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ক্লাসের বাইরেও অনেকটা সময় পাওয়া যায়। এ সময় খণ্ডকালীন চাকরি, ইন্টার্নশিপ, টিউশনির মতো কত কাজেই তো শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়। তরুণ বয়সে মনের খোরাকের জন্য বই পড়া, বেড়াতে যাওয়া, ভালো সিনেমা দেখা, আড্ডা দেওয়া—এসবও তো জরুরি। ক্লাবের কার্যক্রম, পড়ালেখার পাশাপাশি এসব সামাল দিতে গিয়েই ছাত্রছাত্রীরা সময় ব্যবস্থাপনা শেখে। তাদের অবসর সময়টাও কার্যকরভাবে কাজে লাগে।
সমৃদ্ধ হয় সিভি
করপোরেট প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি চাকরি, কর্মক্ষেত্র যা-ই হোক, সাক্ষাৎকারে একটি বিষয় সাধারণত সব চাকরিদাতারাই জানতে চান—আপনি কোনো ক্লাবে যুক্ত ছিলেন কি না? সহশিক্ষা কার্যক্রমের কী অভিজ্ঞতা আপনার আছে? সিভিতে সহশিক্ষার কোনো ছাপ না থাকলে অনেক সময় প্রাথমিক বাছাইতেই বাদ পড়ে যেতে হয়। কারণ, চাকরিদাতারা জানেন, ক্লাবে সক্রিয় শিক্ষার্থীরা অন্য অনেকের চেয়ে দলগত কাজ, নেতৃত্ব, কিংবা চাপ নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে। তাই পেশাজীবনের জন্যও এখন সহশিক্ষা কার্যক্রম ভীষণ জরুরি।
গড়ে ওঠে আত্মবিশ্বাস
এমন বহু শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ক্লাবে যুক্ত হয়েই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। যে ছেলে অনেকের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভয় পেতেন, সেই মঞ্চে তুখোড় বক্তৃতা দিতে শিখেছেন। যে মেয়েটা কখনো ছবি আঁকেননি, সে হয়তো ক্লাবের অনুষ্ঠানে দেয়ালে আলপনা আঁকতে গিয়েই ছবি আঁকার প্রতি তাঁর ঝোঁকটা টের পেয়েছেন। নিজের শক্তির জায়গাগুলো জানা যায় বলেই ক্লাব থেকে মানুষ আত্মবিশ্বাসী হয়।
নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়
সময়ের বিবেচনায় নেটওয়ার্কিং ভীষণ জরুরি একটি দক্ষতা। সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে পেশা ও সামাজিক ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়। নানা পেশার আলোচিত ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পান শিক্ষার্থীরা। এ কারণে ভবিষ্যতের চাকরিজীবন কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে ‘রেফারেন্স’ বা সুপারিশ পেতে সুবিধা হয়। বিভিন্ন আন্তবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমেও নেটওয়ার্ক বাড়ে।
উচ্চশিক্ষা ও বৃত্তির ক্ষেত্রে কাজে আসে
সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা উচ্চশিক্ষার ‘স্টেটমেন্ট অব পারপাস’-এ যুক্ত করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের অভিজ্ঞতা, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের অভিজ্ঞতা বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও বৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজে আসে।