সাঁতরে সাগর পার

বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আট সাঁতারু
ছবি: সংগৃহীত

এবারের ফরচুন বাংলা চ্যানেল সাঁতারে ফেবারিট কারা? বঙ্গোপসাগরের বাংলা চ্যানেল আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাঁকেই জিজ্ঞাসা করেছি, একটা নাম সবাই বলেছেন—‘রাসেল’। সেটাই স্বাভাবিক। ১২ বছরের রেকর্ড ভেঙে ২০১৮ সালে দ্রুততম সময়ে রাসেল শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটারের বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন ৩ ঘণ্টা ৮ মিনিটে। গত বছর তৃতীয় স্থান দখল করেছিলেন। তাই রাসেল, মানে মো. সাইফুল ইসলাম এবারও ছিলেন ফেবারিট। গত ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ১৫তম ফরচুন বাংলা চ্যানেল সাঁতারে ৩ ঘণ্টা ৩১ মিনিট সময় নিয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের স্নাতকোত্তরের এই ছাত্র। তিনিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন ছাত্র এ বছর সাঁতরে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিলেন।

অন্য দিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রী সোমা রায় ৪ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেন। এ বছর বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া ৪০ জন সাঁতারুর মধ্যে দুই নারীর একজন সোমা। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষার্থীর একসঙ্গে বাংলা চ্যানেল জয় করার ঘটনা এই প্রথম। এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আরও চার শিক্ষার্থী বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন।

বুয়েটের সোমা রায় বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন ৪ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটে।
ছবি: মনন মাহমুদ

শখ থেকে বঙ্গোপসাগরে সোমা

বাড়ি ফরিদপুর। ছোটবেলা থেকেই নদীতে সাঁতার কাটার শখ সোমা রায়ের। বুয়েটে পড়তে এসেও সেই শখ রয়ে গেল। ঢাকার আফতাব নগরের এক পুকুরে নেমে পড়তেন সময় পেলেই। পুকুরটা ভরাট হয়ে যায় একসময়, সোমার সাঁতারে ভাটা পড়ে।

সোমা রায় বললেন, ‘গত বছরের আগস্টে প্রথম শুনি বাংলা চ্যানেলের সাঁতারের কথা। কিন্তু চর্চা করব কোথায়?’ এরপর গুলশান সুইমিং ক্লাবের পুকুরে শুরু হলো তাঁর সাঁতার কাটা। কর্মকর্তারা যথেষ্ট সহযোগিতা করলেন। গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলা চ্যানেলের বাছাইপর্বে উতরে গেলেন। ‘এই সাঁতার হওয়ার কথা ছিল মার্চে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ায় স্থগিত হলো আয়োজন। হতাশ হলাম। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। চলে গেলাম ফরিদপুর। সেখানে শহরের মাঝখানে এক পুকুরে ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সাঁতরাতাম।’

এভাবেই বুয়েটের সোমা প্রস্তুত হন বাংলা চ্যানেলের জন্য। পাড়ি দিতে সফল হন। ভবিষ্যতে নিজের সময় আরও কমিয়ে আনতে চান তিনি। পাশাপাশি চান বুয়েটে শিক্ষার্থীদের সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ আরও বেশি করে নেওয়া হোক। মা বনশ্রী বোসই বেশি উৎসাহ দেন সোমার সাঁতারে। বাবা সুকুমার রায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব। থাকেন ফরিদপুরেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আট সাঁতারু

গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার সাঁতারু পাড়ি দিয়েছিলেন বাংলা চ্যানেল। এবার সংখ্যা বেড়েছে। মো. সাইফুল ইসলাম ছাড়া বাকি সাতজনের এবারই প্রথম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এবং সাঁতার ও ওয়াটার পোলো দলের কোচ শাহজাহান আলী বললেন, প্রতিবছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই সাঁতারে অংশ নেন। এবার একটু সংখ্যায় বেশি তাঁরা। তবে এবার সাঁতার অনুশীলন একটু কমই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, বন্ধ ছিল সুইমিং পুলও। তারপরও এই সাঁতারুরা ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে থেকে জহুরুল হক হলের পুকুরে সাঁতারের চর্চা করেছেন। এই আয়োজনে অংশ নিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁদের সহযোগিতাও করা হয়েছে।

ঢাবির আরও যাঁরা বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিলেন তাঁরা হলেন লেদার প্রোডাক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মো. নাজমুল হোসাইন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আলী রওনক ইসলাম, আইন বিভাগের মো. আবু বক্কর সিদ্দিক, সমাজবিজ্ঞানের এবাদুল ইসলাম, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা বিভাগের তানবীর-উল-ইসলাম, সাইফুল ইসলাম তপু এবং উর্দু বিভাগের ছাত্র মো. রেজাউল করিম। এঁদের মধ্যে আলী রওনক ইসলাম প্রথম আলো ঢাবি বন্ধুসভার সদস্য।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন

ঢাকার শেখ বোরহানউদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র উৎসব সরকার এবার নিয়ে দ্বিতীয়বার বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিলেন। এর আগে ২০১৮ সালে প্রথম এই সাঁতার সম্পন্ন করেন। তিনি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশেরও নিবন্ধিত ছাত্র। এ ছাড়া করটিয়ার (টাঙ্গাইল) সরকারি সা’দত কলেজের এমবিএর ছাত্র মনির হোসেন, চাঁদপুর সরকারি কলেজের ইসলামি শিক্ষার আবদুর রহমান এবং ঢাকার আপডেট কলেজ ইনস্টিটিউটের পর্যটন ও হোটেল ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী জিহাদ হুসেন বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন এবার।

তিনবার বাংলা চ্যানেল জয়ী বরগুনার ছেলে মো. সাইফুল ইসলাম এখন স্বপ্ন দেখেন সাত সাগর পাড়ি দেওয়ার।
ছবি: সংগৃহীত

স্বপ্ন তাঁর সাত সাগর পাড়ি দেওয়ার

বিশ্বের বিখ্যাত সাতটি সমুদ্র চ্যানেলকে একসঙ্গে বলে ‘সেভেন ওশেন’। তিনবার বাংলা চ্যানেল জয়ী বরগুনার ছেলে মো. সাইফুল ইসলাম এখন স্বপ্ন দেখেন এই সাত সাগর পাড়ি দেওয়ার। বললেন, ‘লিপটন সরকার ও আয়রনম্যান খেতাবপ্রাপ্ত মোহাম্মদ শামসুজ্জামানের হাত ধরে বাংলা চ্যানেল সাঁতারে আসি। এখন এ ধরনের ম্যারাথন সাঁতার আমার ভালো লাগে। ইংলিশ চ্যানেলসহ সেভেন ওশেন পাড়ি দেওয়া এখন আমার স্বপ্ন।’

এবারের ফরচুন বাংলা চ্যানেল সাঁতার ২০২০-এর আয়োজক ষড়জ অ্যাডভেঞ্চার ও এক্সট্রিম বাংলা। প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডের ব্র্যান্ড ফরচুন। ষড়জের প্রধান নির্বাহী এবং টানা ১৫ বার বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দেওয়া সাঁতারু লিপটন সরকার বলেন, ‘এ ধরনের ক্রীড়া বা অ্যাডভেঞ্চার তরুণদের খারাপ নেশা থেকে দূরে থাকতে সহায়ক হবে। সুস্বাস্থ্য ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য এসবের প্রয়োজন রয়েছে।’

অ্যাডভেঞ্চারগুরু প্রয়াত কাজী হামিদুল হক বঙ্গোপসাগরে সাঁতার উপযোগী এই চ্যানেল আবিষ্কার করেন। ২০০৬ সাল থেকে শুরু হয় বাংলা চ্যানেল সাঁতার।