
সুখী সংসার সম্পর্কে আমাকে কেন লিখতে বলা হয়েছে, জানি না। হয়তো বা প্রথম আলোর কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ অবহিত আছেন যে আমার দাম্পত্য জীবনের অর্ধশতাব্দী আমি ছয় বছর আগেই পূর্ণ করেছি। হয়তো বা আমার সুদীর্ঘ দাম্পত্য জীবন এবং এই অবধি তার স্থায়িত্ব তাঁদের আকৃষ্ট করেছে। এখানে কিন্তু সাবধানবাণীর প্রয়োজন রয়েছে। দাম্পত্য জীবনের দৈর্ঘ্য ক্রিকেটের রানসংখ্যা নয় যে তা যত বেশি তত ভালো। ক্ষেত্রভেদে দীর্ঘ অসুখী দাম্পত্য জীবন দুঃসহও হতে পারে।
আমি এক দম্পতির কথা জানি। অবসরপ্রাপ্ত তাঁরা। ধনাঢ্য না হলেও সচ্ছল। তাঁদের মধ্যে স্বামী থাকেন দুবাইতে আর স্ত্রীর বসবাস লন্ডন শহরে। স্বামীর অভিযোগ, লন্ডনে গেলেই নাকি তাঁকে দিয়ে তাঁর স্ত্রী বাজারের কাজ এবং রান্নাবান্না করাতে চান। স্ত্রীর কথা, দুবাইতে আয়েশি জীবন ছেড়ে এসেছ, এখন কিছু কাজকর্ম করো। সময়ের মাপকাঠিতে যথেষ্ট দীর্ঘ তাঁদের দুবাই-লন্ডন ব্যাপ্তির এই অভিনব সংসার। সেই সংসারকে আমি কি অসুখী বলব? লন্ডন, দুবাইয়ের ফর্মুলায় হয়তো বা তাঁদের সংসার সুখেরই। একত্রে বসবাস যে সুখী সংসারের পূর্বশর্ত হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। একসঙ্গে পথচলার চেয়ে নিজ নিজ পথ চলতে অনেক দম্পতি হয়তো বা সুখের আস্বাদ লাভ করেন।
তবে হ্যাঁ, প্রথাগত অর্থে একটি দম্পতির বসবাস একই ছাদের নিচে। তাঁরা একই বিছানায় ঘুমান, একই খাবার খান, টেলিভিশনে একই প্রোগ্রাম দেখেন, একই চিকিৎসকের কাছে যান। সকালে যে যাঁর কাজে চলে যান, বিকেলে হয় আবার দেখা। সন্তান-সন্ততি স্কুলে যায়, বড় হয়। কখনো বা সমস্যার সৃষ্টি করে। একঘেয়ে তাঁদের জীবনে খাওয়ার পরে রাঁধা আর রাঁধার পরে খাওয়া। ব্যস্ত, তবে বৈচিত্র্যহীন। তাঁরা সুখী না অসুখী, তা ভেবে দেখারই বা সময় কোথায়? সুখী ও অসুখী হওয়ার মাঝামাঝি যে বিরাট স্থানটি রয়েছে, সেখানেই তাঁদের অবস্থান। এ ধরনের না সুখী, না অসুখী সংসার বিরল নয় মোটেও।
সাধারণ ভাবনায়, একটি সুখী বা অসুখী সংসারের কেন্দ্রে রয়েছেন দুজন মানুষ, যাঁরা নিয়তির টানে একই সঙ্গে সংসার পেতেছেন। দুজন মানুষ, দুটি চিন্তাধারা, দুই রকম অভ্যাস, দুই রকম পছন্দ—যে দম্পতি এসবের মাঝে, সমঝোতার মাধ্যমে জীবন কাটাতে পারেন, তাঁদের সংসার অবশ্যই সুখের। ভিন্ন চিন্তা, এমনকি ভিন্ন বিশ্বাসের মাঝে সমন্বয় সম্ভব, আপস সম্ভব। তবে আজকের বাংলাদেশে একটি ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থা বিরাজ তো করতেই পারে, যেখানে স্বামী গোঁড়া আওয়ামী লীগপন্থী আর স্ত্রী কট্টর জাতীয়তাবাদী অথবা তদিবপরীত! আমরা সবাই এখন জানি যে সেখানে কোনো সমঝোতাই সম্ভব নয়। সেখানে নির্বাচন অনুপস্থিত, কোনো তত্ত্বাবধায়কতা নেই, নেই অন্তর্বর্তীকালীন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ। সেখানে দুজন মানুষ, বাংলাদেশের রাজনীতির মতো অর্থহীন সমান্তরাল রেখায় চলছে। অবশ্য সমগ্র জাতি যা সয়ে নিচ্ছে, দুজন মানুষ কেন তা পারবেন না—সে কথাটি অবান্তর নয় মোটেও।
‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। আমাদের জাতীয় সংসার রমণীর গুণে সুখের হয়নি—তাই বলে একটি দম্পতির সংসার যে রমণীর গুণে সুখী হবে না, তা তো বলা যায় না। কিন্তু সেখানে রমণীরা বাদ সাধতে পারেন। তাঁরা বলতে পারেন, গুণ কেন কেবল রমণীরই হবে—গুণধর পুরুষের তাহলে কি প্রয়োজন নেই? প্রশ্নটি যথার্থ। আসলে একটি সুখী সংসার দুজন মানুষের একটি কোয়ালিশন ব্যবস্থা। তবে কড়া নজর রাখা বাঞ্ছনীয়, যাতে সেখানে কোনো ‘তৃতীয় শক্তির’ আবির্ভাব না ঘটে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক জীবনে তৃতীয় শক্তির অভাব আমরা তিলে তিলে অনুভব করছি। তবে একটি দাম্পত্য জীবনে তৃতীয় শক্তি? তা তো সুখের সংসার ছারখার করে দেবে।
একটি আদর্শ সুখের সংসার দিনের পর দিন আসে। সেই প্রভাত, সেই সন্ধ্যা, আলো-ছায়ার মাখামাখি। সুখের সংসারটির বৃন্তে বৃন্তে যৌবনের মঞ্জরি ফুটে ওঠে। অতঃপর? অতঃপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কুঞ্চনের রেখায় রেখায় প্রৌঢ়ত্ব উঁকি মারে। সাদা-কালো কেশ শুভ্র বর্ণ ধারণ করে। প্রৌঢ়ত্ব প্রগাঢ় হয়। তারপর পালিয়ে যায়। জরা-ব্যাধির ডালা নিয়ে আবির্ভূত হয় বার্ধক্য। আনে রকমারি রোগের বাহার। একজনের ডায়াবেটিস তো অন্যজনের রক্তচাপ। একজনের মিষ্টি বারণ, অন্যজনের লবণ। একসঙ্গে থেকেও তাঁরা আর একই খাবারও খেতে পারেন না। তবু তাঁদের জীবন এক সুতোয় গাঁথা থাকে। মুখোমুখি বসার আনন্দ। সুখের সংসারে মুখের হাসি ফুরোয় না—যত দিন না কালের অমোঘ নিয়মে মরণ হানা দেয়।