সেই মনসুর এখন গণশৌচাগারের তত্ত্বাবধায়ক
চট্টগ্রামের ব্যান্ড ‘ব্লু হরনেট’ একসময় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই দলটির অন্যতম সদস্য ছিলেন মনসুর হাসান। টগবগে তরুণ মনসুর গান লিখতেন, গান গাইতেন। তাঁর গাওয়া কয়েকটি গান তখনকার তরুণদের মুখে মুখে ফিরত। সেই মনসুর এখন বন্দর নগরীর একটি গণশৌচাগারের তত্ত্বাবধায়ক। তাঁর জীবনের গল্প শুনে এলেন সুজয় চৌধুরী
১৯৮৬ সালে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে ভর্তি হন মনসুর হাসান। কলেজেই গানপাগল কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয়। তাঁদের সঙ্গে মিলে শুনতে থাকেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যান্ডের গান। আর বুনতে থাকেন নতুন ব্যান্ড গড়ার স্বপ্ন।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্বপ্নটাকে সত্যে পরিণত করেন তাঁরা। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে ছয় বন্ধু মিলে গড়ে তুলেন গানের নতুন দল—ব্লু হরনেট। দলের সদস্যরা কেউ গান লেখা শুরু করেন, কেউ তৈরি করেন সুর, কেউ গাইতেন, কেউ বাজাতেন বাদ্যযন্ত্র। নতুন ব্যান্ড নিয়ে এভাবে কেটে যায় বছর দুয়েক। এর মধ্যেই চলে আসে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। নানা কারণে মনসুরের পরীক্ষা দেওয়া হয় না। এ নিয়ে পরিবারের সঙ্গে তৈরি হয় টানাপোড়েন।
কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ব্যান্ড নিয়ে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন মনসুরের বন্ধুরা। মনসুর তখন গান গাইতেন। গানের কথাও লিখতেন। নব্বইয়ের শুরুতেই তাঁরা বের করলেন প্রথম অ্যালবাম। অ্যালবামের ১৪টি গানের মধ্যে মনসুরেরই ছিল ৩টি—‘বাটালি হিলের সেই বিকেল’, ‘ছোট্ট একটি মেয়ে’, ‘সারাটি রাত’। গানগুলো জনপ্রিয়তা পায়।
মনসুরের এই সময়
মনসুরের বয়স এখন ৫৪। এখন জামালখানের যাত্রীছাউনিতে কাটে তাঁর দিন–রাত। চার বছর ধরে এ যাত্রীছাউনির নিচেই থাকেন তিনি। একটি ছোট বেঞ্চে কাটে তাঁর রাত। দুটি গণশৌচাগারের দেখভাল করেন তিনি। গান গাওয়া, লেখা কিংবা গিটারে সুর তোলা যেন অন্য কোনো মানুষের জীবনের গল্প।
সেখানেই মনসুরের সঙ্গে কথা হয় ১৯ মে। এখন ঠিকঠাক কথাও বলতে পারেন না। জড়িয়ে আসে শব্দ। স্মৃতিও প্রতারণা করে। কোনো বাক্য শুরু করলে আর শেষ হয় না। মাঝপথেই আটকে যায়। তবু মনসুর হাসান স্মৃতির পাতা খুলে বললেন দু-চার কথা। বলেন, ব্যান্ডে ছিলেন তাঁর বন্ধু মোরশেদ, সেলিম ও রাকিব। সবাই মিলে মূলত পপ ঘরানার ব্যান্ড তৈরি করেছিলেন। প্রথম অ্যালবামে সব গানই মৌলিক ছিল। তাই গানগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অনেক জনপ্রিয় শিল্পীও পছন্দ করেছিলেন। উৎসাহ জুগিয়েছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই পপ ঘরানার প্রতি ঝোঁক থাকলেও নানা রকমের গানই শুনতেন মনসুর। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত, রক, আধুনিক—সব গানই মোটামুটি তাঁর শোনা হয়েছে। মান্না দে এখনো তাঁর প্রিয়। ফিডব্যাক, সোলসের গানও তাঁকে বেশ টানত। মহীনের ঘোড়াগুলির গানে একসময় বুঁদ হয়ে থাকতেন। এখন আর গান শোনা হয় না। তবে মন চাইলেই গুনগুন করেন। পুরোনো সেই গানগুলো এখনো তাঁর মনে পড়ে।
জীবনযাত্রা
মনসুরের জীবনটা নাটকীয়তায় ভরা। গান করেছেন, জেল খেটেছেন, রাজপথে স্লোগানও দিয়েছেন। মনসুর বলেন, ছোটবেলা থেকেই বড় একরোখা ছিলেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। তবে বাবা আবুবকর সিদ্দিক ও মা রাবেয়া খাতুন তাঁর রাজনীতি করাটা পছন্দ করতেন না। তাঁর কোনো ভাইবোনও ছিল না। বছর কুড়ি আগে পারিবারিক ব্যবসার ঝামেলায় জড়িয়ে একবার এক মাসের মতো জেলেও ছিলেন মনসুর। বের হয়ে পরিবার থেকে একেবারে আলাদা হয়ে যান। নিজের বাড়ি রহমতগঞ্জ এলাকায় যাওয়া বন্ধ করে দেন। এর মধ্যে মা–বাবা মারা যান। পরে আর বাড়িতে যাওয়া হয়নি।
বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথায় ছিলেন, এমন প্রশ্নে একটু সময় নেন মনসুর। বলেন, ১৯৯২ বা ১৯৯৩ সালের দিকে ব্যান্ড থেকে বের হয়ে যান। এরপর ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সফলতা আসেনি। বিয়েথাও করা হয়নি। শহরের নানা জায়গায় ঘুরে কেটেছে তাঁর দিন। রাতে রাস্তায় থাকতেন। কখনো খাওয়া জুটেছে, কখনো জোটেনি। বছর চারেক আগে জামালখানের মোড়ে গণশৌচাগার দেখভালের কাজ শুরু করেন। মাসে নয় হাজার টাকা পান। এ টাকা দিয়েই তাঁর দিন চলে যায়।
গণশৌচাগারের তত্ত্বাবধায়কই যে ব্লু হরনেট ব্যান্ডের কণ্ঠশিল্পী মনসুর হাসান, তা আবিষ্কার হয়েছে গত সপ্তাহে। তাঁর পরিচয় জেনে মনসুরকে নিয়ে ফেসবুক লাইভে আসেন জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ। ‘বাটালি হিলের সেই বিকেল’, ‘ছোট্ট একটি মেয়ে’ গানের গায়ককে এভাবে দেখে অনেকে স্মৃতিকাতর হয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন।
শৈবাল দাশ বলেন, মনসুর হাসান মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পঞ্চানন আচার্য্যের অধীন তাঁর চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। নব্বই দশকের সাড়াজাগানো এ শিল্পীকে সুস্থ করতে এখন ভালো চিকিৎসা দরকার।