সোয়াট দলের একমাত্র নারী

যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণের সময় l ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণের সময় l ছবি: সংগৃহীত

এপ্রিল ২০১৫। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বন্দরনগরী তখন সরগরম। নির্বাচনের সময়টাতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের তখন মহা ব্যস্ততা। এ সময়ে ভারতের আগরতলা থেকে আসা এক শিশুর আশ্রয় হয় চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে।
জীর্ণশীর্ণ শিশুটিকে দেখেই কেঁদে উঠল পুলিশের পোশাকের আড়ালে থাকা মাহমুদা বেগমের মন। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনারের (ট্রাফিক) নিয়মিত দায়িত্বের বাইরে এ ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারেরও দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। বর্তমানে তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া শিশুটির শারীরিক অবস্থা তখন খুব খারাপ। মাহমুদা নিজেই শিশুটিকে নিয়ে ছুটলেন চিকিৎসকের দরজায়। চিকিৎসা আর মাহমুদার নিবিড় পরিচর্যায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে শিশুটি। এরপর ওই শিশুকে ভারতে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে কোনো শিশু এলেই তাকে মায়ের মমতায় কোলে তুলে নিতেন মাহমুদা। সেই মাহমুদা বেগমই ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট ছুড়তে পারেন। ব্লক-১৭ পিস্তল আর অত্যাধুনিক এম ৪ রাইফেল হাতে সম্মুখযুদ্ধে সন্ত্রাসীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্রমাগত গুলি ছোড়ার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। মাহমুদা এখন পুলিশের স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিকস (সোয়াট) দলের একমাত্র নারী সদস্য। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আমন্ত্রণে ভার্জিনিয়ার ওগারা ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিজ থেকে সর্বাধুনিক অস্ত্র চালনাসহ ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন উদ্ধারকাজের ওপরও বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। এই মাহমুদা পুলিশে যোগ দেওয়ার আগে দুই বছর শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও সোয়াটের দায়িত্বপ্রাপ্ত আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা ও চট্টগ্রাম মিলিয়ে সোয়াট দলের সদস্য প্রায় ৬০ জন। এদের মধ্যে একজনই কেবল নারী। সোয়াট গঠন করা হয়েছে মূলত বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ মোকাবিলার জন্য। যেখানে মুখোমুখি গুলিবিনিময় থেকে শুরু করে নানা ধরনের ঝুঁকি থাকে। ওই ধরনের কাজের সঙ্গে একজন নারীর যুক্ত হওয়া নিঃসন্দেহে এক সাহসী ঘটনা। একই সঙ্গে পুলিশসহ সবার জন্য গর্বেরও বিষয়।’
যদিও বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কোনো অভিযানে সোয়াট দলকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়নি। তবে গত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় খেলোয়াড়দের নিরাপত্তায় এবং বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মাঠে ছিলেন সোয়াট দলের সদস্যরা।
মাঠের অভিযানে কার্যকরভাবে সোয়াটের বিশেষ প্রশিক্ষণ কাজে না লাগলেও অস্ত্র চালনাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়মিত চর্চা করেন মাহমুদা। বছরে অন্তত একবার দলের অন্য সদস্যদের নিয়ে রাঙামাটিতে চলে যান বুলেটের নিশানা ঠিক রাখার প্রশিক্ষণে। বর্তমানে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সাত সদস্যের সোয়াট দলের প্রধান তিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ২৮তম বিসিএসের মাধ্যমে ২০১০ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন মাহমুদা বেগম। তিনি বললেন, শুটিং বা অস্ত্র চালানোর ওপর রয়েছে বিশেষ দক্ষতা ও আগ্রহ। চ্যালেঞ্জিং কিছু করার আগ্রহ থেকেই ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সোয়াটের প্রশিক্ষণের জন্য আবেদন করি। প্রথমে ছিলাম অপেক্ষমাণ তালিকায়। পরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাকে এ প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করে।’

এ ধরনের প্রশিক্ষণের জন্য শারীরিক সক্ষমতার দিকটি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর কারণ হিসেবে মাহমুদা বলেন, ‘সোয়াটের সদস্য হিসেবে বুলেট প্রুফ যে জ্যাকেটটি পরতে হয় সেটিরই ওজন ৩০ কেজি। পাশাপাশি আছে পোশাক-আশাক আর ভারী অস্ত্র।’

তবে অস্ত্রের ব্যবহারের চেয়ে মানুষের জন্য মানবিক কিছু করতে পারার আনন্দটাই বেশি টানে তাঁকে। এ কারণে সোয়াটের বিশেষ প্রশিক্ষণের চেয়ে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ২০০ মানুষকে সহায়তার তৃপ্তির আনন্দকে এগিয়ে রাখছেন তিনি।

পুলিশের দায়িত্বশীল সব কাজ উপভোগ করেন মাহমুদা। তবে কষ্ট একটাই, কাজের কারণে একমাত্র সন্তানের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়। আগামী এপ্রিলে মাহমুদা যাচ্ছেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যুদ্ধবিধ্বস্ত কঙ্গোতে।