স্থাপত্যের সঙ্গে আমার শুরু

স্থপতি বাবা মোহাম্মদ শহীদুল হকের সঙ্গে মেয়ে উম্মে তাহমিনা হক
ছবি: সৌরভ দাশ

বাবার অফিসের মেঝেতে বসে আমরা যে ‘মাথা ধরা গন্ধের’ মার্কারগুলো দিয়ে খেলতাম, সেগুলোর জন্য, নাকি পারিবারিক জিনগত বৈশিষ্ট্যের কারণে জানি না, আমি আর আমার বোন দুজনেই স্থাপত্যে ডিগ্রি নিয়েছি।

মনে আছে ছেলেবেলায় বাবাকে দেখতাম, তাঁর ড্রাফটিং টেবিলে ট্রেসিং পেপার আর মেকানিক্যাল পেনসিল নিয়ে আঁকিবুঁকি করতেন। পুরোনো ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজত। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাবা ভাবনার রাজ্যে ডুবে যেতেন। বাবার আশপাশে আমরা পেয়ে যেতাম মহামূল্যবান খেলনাগুলো—মার্কার, নানা রঙের শত শত কলম, কাগজ, আরও কত কিছু। এই খেলনা আর বাবার চায়ের কাপের তলানিতে রয়ে যাওয়া ঠান্ডা চায়ে টুক করে একটা চুমুক—ব্যস। মনে হতো জীবনে আর কী চাই!

স্থপতি বাবা মোহাম্মদ শহীদুল হকের সঙ্গে মেয়ে উম্মে তাহমিনা হক
ছবি: সৌরভ দাশ

আমরা দেখতাম, বাবা ছোট ছোট ভবন বানাতেন (এ দৃশ্য এখনো দেখি)। সুতা আর তার দিয়ে ছোট ছোট গাছ বানাতেন। আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতাম। আমাদের সাহায্য নেওয়ার জন্য বাবাকে একরকম জোর করতাম। এখন বুঝি, কেন বাবা আমাদের সাহায্য নিতেন না।

কখনো কখনো বাবা আমাদের তাঁর অফিসে নিয়ে যেতাম। আমরা তাঁর ড্রাফটিং টেবিলের ওপর পা ছড়িয়ে বসে হোমওয়ার্ক করতাম। বাড়ি ফেরার সময় বাবা আশপাশটা ঘুরে দেখাতেন। আমাদের শহর, বাড়িঘর, আর এসবের নামকরণের পেছনের কথা বলতেন। মুঘল কিংবা ঔপনিবেশিক আমলের কাঠামোগুলোর গল্প বলতেন। কিংবা সেই ভবন দেখাতে নিয়ে যেতেন, যেটার নির্মাণকাজের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে আছেন।

বাবা আজীবন আমাদের শুধু ভালোবাসাই দিয়ে গেছেন। কখনো তাঁর মতামতটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি। আমাদের সমাজ মেয়েদের বোঝা মনে করে। কিন্তু আমার মা-বাবা কখনোই সেটা অনুভব করতে দেননি, এমনকি যখন আমরা কোনো অপ্রচলিত পথে হেঁটেছি, তখনো।

তাই ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে পা রাখার বহু আগেই আমার স্থাপত্যের ‘ক্লাস’ শুরু হয়ে গিয়েছিল। হয়তো বাবার জীবনযাত্রা, সারল্য কিংবা মুক্তচিন্তা আমাকে আকর্ষণ করেছিল।

স্থাপত্যের পড়ালেখায় যে পরিশ্রম, ত্যাগ আর ঘুমহীন রাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটা বাবার চেয়ে ভালো আর কে জানে। তাই বাবা চাননি আমরা স্থাপত্য নিয়ে পড়ি। কিন্তু নিয়তিকে কে এড়াতে পারে!

এখন বাবা অবসর নিয়েছেন। আর আমি সদ্যই পড়ালেখা শেষ করে পেশাজীবনে পা রাখার অপেক্ষায় আছি। তবে আমার স্থাপত্যের ক্লাস শেষ হয় যায়নি। এখনো বাবার কাছে শিখি। এখনো মাঝেমধ্যেই ডাইনিংরুম আমার ক্লাসরুম হয়ে যায়।