হঠাৎ গেল থেমে

গাড়িটা নষ্ট হওয়ার আর সময় পেল না। ঠিক মাঝরাস্তায়। তা-ও রাত পৌনে ১২টায়। কোথায় আছি, সেটাও বুঝতে পারছি না। আশপাশে মানুষের কোনো আনাগোনা নেই। দোকানপাট থাকলে না হয় সাইনবোর্ড দেখে অবস্থানটা জানা যেত।

রাস্তার দুই ধারে মেহগনিগাছ। বাঁ দিকে সারি সারি ধানখেত। ডান দিকে উঁচু সেগুনগাছের বাগান আর নিচে বেতগাছের ঝোপ। আমরা শেষ যে বাজারটা অতিক্রম করেছি, সেটা এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। আমাদের গন্তব্য ফরেস্ট রিসোর্ট এখান থেকে চার কিলোমিটার দূরে। কাউকে ফোন দিয়ে সাহায্য চাওয়ার উপায়টাও বন্ধ, কারণ কারও ফোনেই নেটওয়ার্ক নেই।

তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, হেঁটেই রিসোর্টের দিকে রওনা দিতে হবে। টিম লিডার জানালেন, বনের ভেতর দিয়ে একটু শর্টকাট আছে। আমরা সে পথেই হাঁটতে শুরু করলাম।

শীতের রাত, ঝিঁঝি পোকা ডাকছে, কয়েকটা শিয়াল হুক্কাহুয়া করতে করতে এদিকেই আসছিল। তবে আমাদের সংখ্যায় বেশি দেখে তেমন সুবিধা করতে পারল না, পালিয়ে গেল। বেতের কাঁটা সুযোগ পেলেই আঁচড় বসিয়ে দিচ্ছে। আমরা যথেষ্ট সাবধানে পা ফেলছি। বন্য অধিবাসীদের বিরক্ত করার আমাদের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। কুয়াশায় টর্চের আলো বেশি দূর যাচ্ছে না, মনের ভেতর কেমন যেন একটা ভয় কাজ করছে। কয়েকজন মিলে গান ধরল মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য। ওদের বেসুরো গানে পাখিরা বিরক্ত হয়ে জেগে ওঠে, কিচিরমিচির করতে থাকে। একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে, সতর্ক হয়। বনে অপরিচিতের আগমনবার্তা সবাইকে জানিয়ে দেয়।

ঘণ্টা দেড়েক হাঁটার পর নেটওয়ার্ক পেলাম। আর সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সবার ফোন বেজে উঠল। ফোনের ওপাশের মানুষগুলো ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিল, বোঝা যায়। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হলো। একটি মেসেজ পেলাম।

‘ভয়টা সাময়িক আর অ্যাডভেঞ্চারটা সারা জীবন যত্ন করে তুলে রাখার মতো। তাই ভয় না পেয়ে জোছনা দেখ। পত্রহীন ডালপালা আঁকিবুঁকি রেখা টেনে দিয়েছে চাঁদের মুখে, তাই না?’

মেজাজটা খারাপ থেকে খারাপতর হয়ে গেল। আমি এ মুহূর্তে কোথায় কীভাবে আছি সেটা না জেনেই ফালতু মেসেজ।

উত্তর দিলাম, ‘ডু ইউ হ্যাভ অ্যানি আইডিয়া, হোয়ার আই অ্যাম?’

সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যুত্তর এল, ‘মাইলদা সড়ক থেকে ২.৪ কিমি ডানে, বাতাবন রিসোর্ট থেকে ১.৩ কিলো দূরে একটি জঙ্গলের ভেতরের হাঁটাপথে।’

মিলে গেছে, তবু অবাক হলাম না, হয়তো আমার লোকেশন অন করা। তার মানে সে কি প্রতি মুহূর্তে আমার লোকেশন দেখে। তাহলে যখন নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলাম, তখন সে কী করছিল?

শীতের আকাশ, মেঘমুক্ত, পরিষ্কার। এখানে নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা নেই, শহুরে জীবন থেকে অনেক দূরে, যেখানে চাঁদের শীতল আলোয় আলোকিত চারদিক। গাছের পাতা ঝরে গেছে সব, গাছগুলো কেমন লক্ষ্মীছাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর হিজিবিজি রেখা টেনে দিয়েছে চাঁদের মুখে।

নওরীন নাহার

খুলনা