হাত ফসকে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমাকে মায়ের কোলে শোয়া অবস্থায় দেখে খিলখিল করে হেসে ওঠে শশী, ‘ওমা! অত্ত বড় ছেলে মা’র কোলে!’ আমি মায়ের কোলে শুয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, মা আমার চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। মা আমার প্রথম ও প্রধান এক পরম বন্ধু। মা জানেন, কেন আমি আজ একবুক হতাশা নিয়ে তাঁর কোলে মাথা রেখেছি। মা সান্ত্বনার সুরে বলেন, ‘আল্লা আল্লা কর।’
গতকালই সরকারি চাকরির বয়সসীমা পার করেছি। এখন আর প্রত্যাশা নেই, আশাও চলে গেছে সপ্তাহ দু-এক হলো। বুকের গভীর থেকে ধেয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসেরা বিস্ফোরণে বাইরে বেরিয়ে এলে মা অশ্রুসিক্ত হন, আমাকে সবুর করার তালিম দেন। আমি নিজেকে সংবরণ করতে পারি না। যখন এইচএসসি পাস করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য দৌড়াদৌড়ি করি, তখন দুলাভাই বেশ জোর দিয়ে সেনাবাহিনীতে সাধারণ সৈনিক পদে ঢুকে যাওয়ার জোর তাগাদা দিয়েছিলেন। মা তাতে সায় দেননি। মায়ের ইচ্ছে, তাঁর একমাত্র ছেলে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হয়ে বাড়িজুড়ে গৌরবের উপলক্ষ হবে। হলোও তা-ই, তবে যা হলো না—কোনো একটা সরকারি চাকরি কপালে জুটল না।
আব্বার বিরস মুখ বিড়বিড় করে বলে, ‘ধুত্তোর, পড়লিই খালি; কাজের কাজ কিছুই হলো না।’ পারতপক্ষে আমি আব্বার সামনে গিয়ে দাঁড়াই না। সারা জীবনের ক্লান্তি, জরা ও সন্তানের বেকারত্বজনিত দুশ্চিন্তার প্রলেপ তাঁর মুখে মাখানো থাকলে সে মুখকে আমার বড় অচেনা ও অদ্ভুত লাগে। শিক্ষাজীবনে প্রথম হওয়া আমিই আজ চাকরির দুয়ারে মাথা ঠুকে মরেছি! অথচ একসময় মায়ের স্বপ্ন সংক্রমিত হয়ে আব্বার চোখেও বাসা বেঁধেছিল, ‘আমার ছেলেডার একটা কিছু তো হইবই!’
সেই আমার আর ‘একটা কিছু’ হয়নি। আর ‘এই একটা কিছু’ না করতে পারার ব্যর্থতায় আমাকে আশা ছাড়তে হয়েছিল। বিবর্ণ মুখে বিরক্তির ছাপ এনে শেষ দেখায় সে কেবল এটুকুই বলেছিল, ‘দেখো সজল, অন্তত একজন বেকারের সঙ্গে আমার...’ বাক্য শেষ করতে যেসব শব্দের প্রয়োজন, তা শোনার দরকার পড়েনি আমার। আমি বুঝে গিয়েছিলাম, সে আর আমার অপেক্ষায় থাকছে না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তখন আমার আর কিছুই করার ছিল না।

এক সকালবেলায় উঠোনের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা নিমগাছটার তলায় ভীষণ বিষণ্নতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পাঁচ বছর বয়সী ভাগনি শশী আমার হাতের আঙুলগুলোকে তার হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে আমার সঙ্গে দাঁড়ায়। শিশুসুলভ আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে গাছ, গাছের ডাল, ডালের ওপর বসে থাকা দোয়েল। বাঁ হাতের তর্জনী উঁচিয়ে বসে থাকা পাখিটাকে নির্দেশ করে সে জানতে চায়, ‘মামা, ওটা কী পাখি?’ আমি মুখ তুলে উত্তর দিতে যাব, এমন সময় অপরাধী গলায় ডাক দেন মাস্টার কাকা, ‘বাবা, একটা গোলমাল হয়ে গেছে যে...’ পরিচিত পিয়ন চাচার শঙ্কিত গলার স্বরে আমি অশুভ কিছু একটার অনুমান করতেই পিয়ন চাচা ফের মুখ খোলেন।

ডাকযোগে আরও এক মাস আগেই আমার নামে এসেছিল এক নিয়োগপত্র। এমন সময়েই সেই চিঠি এসে হাতে পৌঁছাল, যখন যোগদানের নির্ধারিত তারিখের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে! আমার হাত ফসকে চিঠিটা পড়ে যায়। অবুঝ ছোট্ট শশী সেই মেয়াদোত্তীর্ণ চিঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে বাড়িসুদ্ধ দৌড়াতে থাকে। তার কণ্ঠে নিষ্ফল উচ্ছ্বাস, ‘মামার চাকরি অইছে, মামার চাকরি...’

ইংরেজি বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ।