হাসপাতাল প্রাঙ্গণে নেমে এল মৃত্যুর স্তব্ধতা

১৯৭১ সাল, তখন কতই বয়স আমার—সাত কি আট বছর। আমি মা-বাবা, এক ভাই ও এক বোনের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে দানবীর রণদাপ্রসাদ (আর পি) সাহা প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী হাসপাতালের চিকিৎসকদের আবাসিক ভবনে বাস করি। বাবা ডা. এম এ হালিম চৌধুরী ছিলেন হাসপাতালটির ডেপুটি সুপার ও চিফ রেডিওলজিস্টের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।

মির্জাপুর ছিল মূলত বণিক সম্প্রদায়ের ব্যবসার ক্ষেত্র। অধিবাসীর বেশির ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের। ফিতার মতো রুপালি লৌহজং নদটি মির্জাপুরকে দুই ভাগ করেছে, ওপারে যারা বাস করত, তারা সবাই ছিল হিন্দু। আর পি সাহার বাড়িও ছিল নদীর ওপারে। এপারে অন্যদের সঙ্গে বাস করত মুসলমান সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িকতার মনোভাব ছিল না। তাদের জীবন আবর্তিত হতো আর পি সাহা প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল ও ভারতেশ্বরী হোমসকে ঘিরেই।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ঘটনা এখনো বিশ্বের ইতিহাসে হৃদয়বিদারক আর ভয়াল রাত হিসেবে গণ্য। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং মির্জাপুর গ্রামে এসে থানার মাঠে ক্যাম্প করে। সেই দিনই তারা হাসপাতাল পরিদর্শনে আসে। তখন হাসপাতালের মেডিকেল সুপার ছিলেন ডা. হাফিজুর রহমান। তিনি খুব সাহসী ও দক্ষ প্রশাসনিক ব্যক্তি ছিলেন। প্রথম দিন এসেই পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আয়ুব তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন হিন্দুদের অবস্থান। ডা. হাফিজুর রহমান বলেন, এখানে কোনো হিন্দু-মুসলমান নেই, আছে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগী আর তাদের চিকিৎসা ও সেবার জন্য চিকিৎসক ও নার্স। তাঁর জবাব শুনে ক্যাপ্টেন আয়ুব ভীষণ রেগে গিয়ে বলেন, 'ঠিক আছে, কেউ যেন হাসপাতাল কম্পাউন্ড ছেড়ে না যায়।'

সেদিন কেউ ব্যাপারটা তেমন গুরুত্ব দেননি। কিন্তু সন্ধ্যায় গ্রামের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি, চিকিৎসক, মিসেস পতি (আর পি সাহার ছোট মেয়ে) একত্র হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে কোনো অসহযোগিতা করা হবে না। কারণ, হাসপাতালের রোগী ও হোমসের নিরাপত্তার জন্য এটা প্রয়োজন। তবু মাঝেমধ্যেই পাকিস্তানি আর্মি এসে চিকিৎসকদের ধমক দিত। সতর্ক করে দিত। তাঁরা যেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা না করেন। একদিন এক কর্মকর্তা আমার বাবার সামনে তার রিভলবার নাচিয়ে বলে, 'দেখো ডাক্তার, আমার রিভলবারটি কিন্তু এখনো গরম আছে। এটা দিয়ে দিনে বেশ কয়েকজনকে খতম করি। সুতরাং সাবধান।' তার কথা শুনে আমার বাবা হতবাক হয়ে যান। তবু কোনো জবাব দেননি।

৭ মে নারায়ণগঞ্জ থেকে হানাদার বাহিনী আর পি সাহা এবং তাঁর একমাত্র ছেলে রবিকে ধরে নিয়ে যায়। এদিকে মির্জাপুরে চালায় তাণ্ডব। এই ঘটনা ওদিকে আর পি সাহাকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় এখানকার সবাই নিজেদের অসহায় ও নিরাপত্তাহীন ভাবেন। এরপর হাসপাতালের কর্মচারী, চিকিৎসক, নার্স, শিক্ষক—সবাই পরিবার নিয়ে গ্রামেগঞ্জে যে যেদিকে নিরাপদ মনে করলেন, চলে গেলেন। শুধু মুষ্টিমেয় কজন রয়ে গেলেন।

ডা. হাফিজুর রহমান, ডা. অফিল সাহা, কেমি সাহা, শিক্ষকদের মধ্যে মিস মুৎসুদ্দি, হেনা সাহা এবং আরও কয়েকজন থেকে যান মির্জাপুরে। আমরা যারা রয়ে গেলাম, তারা আর পি সাহার পরিবারকে বিভিন্ন পর্যায়ে সহযোগিতা করেছি।

যে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ মানুষের (সুস্থ-অসুস্থ) আনাগোনায় সব সময় মুখর থাকত, সেখানে নেমে এল মৃত্যুর স্তব্ধতা। হাসপাতাল ছাড়াও নিজস্ব পারিবারিক সমস্যাও আমাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিল। চারদিকে চাপা উত্তেজনা আর গুজব, ঘর থেকে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর্মি ক্যাম্পে। এরপর তাদের খোঁজ পাওয়া যায় না।

আমাদের বাসায় আমরা দুই ভাই ও বড় বোন এবং ছোট ফুফু। আমার বাবা হাসপাতালে যাওয়ার সময় বাইরের গেটে তালা দিয়ে যেতেন, যাতে পাকিস্তানি হানাদারেরা মনে করে বাসায় কেউ নেই। তবু হাসপাতাল চত্বরের বাইরে থেকে আসা গুমগুম গুলির আওয়াজ আর দূরাগত মর্টারের শেলের শব্দ শুনে খাওয়াদাওয়া, ঘুম, আরাম-আয়েশ ভুলে আতঙ্কের মধ্যে দিনরাত কাটাতাম। নিশ্বাস ফেলতেও যেন ভয়, জোরে কথা বলা, ঘরে আলো জ্বালানো নিষেধ, ঘরের বাইরে একটা পাতা ঝরার আওয়াজেও চমকে উঠতাম। মনে হতো বুঝি পাকিস্তানি আর্মির বুটের শব্দ, বন্ধ দরজার ওপারে তারা দাঁড়িয়ে। মৃত্যুবিভীষিকা নিয়ে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর ছায়ার নিচে বসবাস। এভাবে কি মানুষ বাঁচে? আমরা কিন্তু বেঁচে ছিলাম। অদ্ভুত এক সময় পার করেছি—আমরা যা ভুক্তভোগী, তারা ছাড়া কারও পক্ষেই তা অনুমান করা সম্ভব নয়।

সময় থেমে থাকে না, আপন গতিতে চলে। বন্ধুবান্ধবের অসহায় মৃত্যুর রক্তরেখা ও রুদ্ধশ্বাস প্রহরকে সঙ্গী করে আমাদেরও দিন কেটে যাচ্ছিল। এর মধ্যে একঝলক দখিনা বাতাসের মতো কানে এল, ওরা এসেছে। আমাদের জীবন কাঠি মুক্তিযোদ্ধার দল। এরপর অজানা কুয়াশার মধ্যে একটি শব্দের জন্য প্রতীক্ষা, 'স্বাধীনতা'।

ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ সকাল ১০টার দিকে মির্জাপুর বাজারের ওদিকে অগণিত মানুষের কলকোলাহল। ব্যাপার কী, জানার জন্য ছাদে গিয়ে দাঁড়াই। দেখতে পাই টাঙ্গাইল-ঢাকা মহাসড়কে হাজার হাজার মানুষের ঢল। ছত্রীসেনা ও মুক্তিযোদ্ধারা 'জয় বাংলা' স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে হাসপাতালের দিকে। আমি আর আমার ছোট ভাই 'জয় বাংলা' বলে দৌড় দিই ওই জনতার দিকে। মা-বাবা বাধা দেওয়ার সুযোগই পেলেন না। পরে বাবাও তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আমরা দুই ভাই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে আসি আর চিৎকার করে বলি, 'আম্মা আমাদের বিজয় হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা স্বাধীন...স্বাধীন।'