হ্যানয়ের জীর্ণতাও যখন সুন্দর

গত বছর বইমেলা চলাকালে ঢাকা বরাবরের মতোই যানজটে বিপর্যস্ত ছিল। মধ্য শহরের ফুটপাতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। আমি সারা শহর হেঁটে বেড়াচ্ছি হিমালয়ে ট্রেকিংয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে। তারই মাঝখানে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে আমাদের পাঁচ দিনের জন্য ভিয়েতনামে যাওয়ার কথা। স্ত্রী রানি, আমি আর আমাদের ছেলে ও ছেলের বউ। বেড়াতে যাওয়ার কথা হ্যানয় আর হালং বে শহরে।

চীন থেকে কোভিডের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। আশপাশের কয়েকটি দেশে তা ছড়িয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ভ্রমণ তখনো বন্ধ হয়নি। যাব কি যাব না ভাবতে ভাবতেই যাওয়ার তারিখ চলে আসে। মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরে আমরা বিমানযাত্রা সারি। ঢাকা-ব্যাংকক-হ্যানয়। হাত ধুতে ধুতে আর স্যানিটাইজার ঘষতে ঘষতে হ্যানয়ের নির্দিষ্ট হোটেলে পৌঁছাই।

হ্যানয়ের ওল্ড কোয়ার্টার এলাকায় লেখক

হ্যানয় শহরের মাঝখানে বিশাল লেক। তার ঠিক পাশেই আমাদের হোটেল। এখান থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় উঠলেই নানা ধরনের ক্যাফে আর রেস্তোরাঁর দেখা মেলে। অল্প কয়েকটি নতুন, তবে বেশির ভাগ ক্যাফেই খুব ঐতিহ্যবাহী আর পুরোনো। তাদের সাজসজ্জা, খাবার ও কফি এই শহরের ফরাসি অতীতের কথা সগৌরব ঘোষণা করে। এসব বিলাসী ও প্রাচীন রেস্তোরাঁর বিষয়ে আমার আগ্রহ আছে। তবে তার চেয়ে বেশি আগ্রহ পুরোনো হ্যানয়ের অলিগলির ভেতর বাড়িঘর আর সেখানকার ছোট, পুরোনো, ঐতিহ্যবাহী ক্যাফেগুলোয় ঘুরে ঘুরে ফরাসি ও ভিয়েতনামি সংস্কৃতির মিলনে গড়ে ওঠা পরিবেশটা দেখায়।

তখনো সবার মাস্ক পরার দরকার আছে কি নেই, তা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনস্থির করতে পারেনি। তবু আমরা মাস্ক পরেই হেঁটে হেঁটে হ্যানয় শহরটা চষে বেড়াই। ভিয়েতনাম আর এর প্রধান শহরগুলোর নাম ছোটবেলায় প্রতিদিন শুনতাম। মনে পড়ে, ছোটবেলায় টাপুরটুপুর পত্রিকায় পড়া ভিয়েতনাম যুদ্ধের খবরাখবর আর মোরশেদ শফিউল হাসানের অবিস্মরণীয় বই অবাক নাম ভিয়েতনাম–এর কথা।

জীর্ণতার সৌন্দর্য

পুরোনো হ্যানয়ের এলাকাটার নাম ওল্ড কোয়ার্টার। গোলকধাঁধার মতো সরু গলিপথ। পর্যটকদের হেঁটে বেড়ানোর সুবিধার্থে কিছু কিছু গলিপথে ট্রাক, বাস, গাড়ি চলে না। এখানে আছে প্রচুর মোটরসাইকেল আর নানা রকম শব্দ। দুই পাশে স্থানীয় খাবারের রেস্তোরাঁ। আর পথের ওপরই ছোট ছোট প্লাস্টিকের টুলের ওপর বসে অনেকে খাচ্ছেন নানা স্বাদের স্ট্রিট ফুড। সেসব খাবারের বিচিত্র ঘ্রাণ, পোড়া পেট্রলের গন্ধ, ঘামের গন্ধ আর সুবেশ পর্যটকদের গা থেকে ভেসে আসা চকিত সুবাস। সব মিলিয়ে বেশ প্রবল একটা অভিজ্ঞতা। একটু প্রশস্ত রাস্তায় পর্যটকদের জন্য রিকশাভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। অনেকটা আমাদের এখানকার মতোই সাইকেল–রিকশা। তবে সেটার সামনের অংশে দুই চাকা। সেখানেই যাত্রী বসেন। আর পেছনের অংশে বসে প্যাডেল চালান চালক।

রাস্তা মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। দুপাশের বাড়িগুলো যে অনেক পুরোনো, তা দেখেই বোঝা যায়। বেশির ভাগ বাড়ি ছোট এবং তিন–চার তলাবিশিষ্ট। সরু সিঁড়ি ওপরের দিকে উঠে গেছে। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী নিচে দোকান আর ওপরে তার মালিকের বাসগৃহ। এসব প্রাচীন ও জীর্ণ ভবন বেশ পরিপাটি করে রাখা। পুরাতনের একটা মহিমা আছে, জীর্ণতারও আছে সৌন্দর্য। এখানে এখনো প্রচুর পর্যটকের ভিড়।

কোনো কোনো দোকানে বান মি কেনার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়

আমার ছেলের বউ ক্রিস্টিন আমেরিকা থেকে আসার আগেই তালিকা করে এনেছে কোন ক্যাফেতে কী ধরনের কফি খেতে হবে আর কোন গলির ভেতর কোন ক্যাফের কী ইতিহাস। এমনি দুই–তিনটি ক্যাফেতে আমরা কফি খেতে যাই। ঠান্ডা আর গরম দুই রকম কফিই জনপ্রিয়। কাফে সুয়া দা মানে দুধ-কফি। কিন্তু আমরা চেখে দেখতে চাই কাফে ত্রুং। এটাই ঐতিহ্যবাহী ভিয়েতনামি কফি, যার মধ্যে কফি আর কনডেন্সড মিল্ক তো আছেই, সঙ্গে রয়েছে ডিমের কুসুম। হালকা হলদে রঙের ঘন পানীয়। কফি সুস্বাদু, তবে এর স্বাদ ঠিক সাধারণ কফির মতো নয়। ক্রিস্টিন ও ইফরাদ খুঁজে বের করে বান মি বা ভিয়েতনামি বাগেত স্যান্ডুইচের সবচেয়ে জনপ্রিয় দোকান।

হ্যানয় শহরের যেদিকেই যাই, সবখান থেকেই কোনো না কোনো লেকের একটা অংশ দেখতে পাই। মনে হয় একটা বড় লেক তার শাখা–প্রশাখা পুরো শহরে ছড়িয়ে রেখেছে। পরে খোঁজ করে জানতে পারি, এই শহরে লেক রয়েছে পাঁচটি। তবে শহরের মাঝখানে ওয়েস্ট লেক আর তার চারপাশের আঠারো কিলোমিটার রাস্তা, ঘরবাড়ি, হোটেল সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে একটা শান্ত পরিবেশ। আর ওল্ড কোয়ার্টারের ঠিক মাঝখানে আছে হোয়ান কিয়েম লেক।

হো চি মিনের সমাধিসৌধ

হো চি মিনের স্মরণে তৈরি বিশাল স্মৃতিসৌধের সামনে হেঁটে বেড়াতে ভালো লাগে। এখানেই রাখা আছে তাঁর মরদেহ। তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো লাগে এই সমাধিসৌধের অদূরে একটা শান্ত এলাকা, যেখানে আছে হো চি মিনের বাড়িঘর ও অফিস। তাঁর ব্যবহৃত অতি সাধারণ গাড়ি আর আসবাব। গত শতাব্দীতে আমাদের এই অঞ্চলের একেকটি জাতির জাগরণে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই অসামান্য মানুষেরা কত সামান্য বাড়িঘরে কেমন সাধারণ জীবনযাপন করতেন, তা আরেকবার মনে পড়ল এখানে হাঁটতে হাঁটতে।

হালং বের নীরবতা

হালং বে

ওয়েস্ট লেকের পার দিয়ে হেঁটে, হ্যানয়ের পুরোনো শহরের অলিগলিতে ঘুরে, নানা ধরনের রেস্তোরাঁ আর ক্যাফেতে খেয়েদেয়ে, গল্প করে কয়েকটা দিন চমত্কার কেটে যায়। মাঝখানে এক দিন বেড়িয়ে আসি হালং বে থেকে। হ্যানয় থেকে ভোরবেলা রওনা দিই। উত্তর ভিয়েতনামের গ্রামীণ দৃশ্যাবলির ভেতর দিয়ে পূর্বদিকে ছুটে চলে আমাদের গাড়ি। চারপাশের প্রকৃতি অসামান্য সুন্দর। বেশির ভাগ এলাকায় জনবসতি চোখে পড়ে না। দীর্ঘ যাত্রার মাঝখানে অল্প সময়ের বিরতি। বিরতির পর হালং বের দিকে যাবার পথে সমুদ্রের কিছু অংশে দেখতে পাই মুক্তার চাষ।

হালং বে বন্দরে পৌঁছে আমাদের সমুদ্রভ্রমণের লঞ্চ খুঁজে বের করি। ছোট ও মাঝারি আকারের জলযান আছে এখানে। আমাদের লঞ্চ কয়েকটা নির্দিষ্ট দ্বীপে থেমে যাত্রীদের ঘুরে বেড়ানোর সময় দেয়। ওখানে একটা দ্বীপে উঁচু টাওয়ার আছে, সেটাতে ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য। তবে বেশ কটি সিঁড়ি পার হয়ে ওপরে ওঠার পর চারদিকের যে অপরূপ দৃশ্য দেখি, তাতে পরিশ্রম সার্থক হয়। আর একটা দ্বীপে রয়েছে বিশাল একটা গুহা। অল্পসংখ্যক পর্যটকের সঙ্গে আমরা হেঁটে বেড়াই সেই গুহার ভেতর।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লেখক

হ্যানয়ের রাস্তায়, দোকানপাটে যথেষ্ট ভিড় থাকলেও হালং বেতে গিয়ে টের পাই, পর্যটকের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। সবখানেই একধরনের বিষণ্ন নীরবতা। সমুদ্রের মাঝখানে জেগে থাকা জনবসতিহীন উঁচু পাহাড়ের মতো দ্বীপগুলো দেখতে ভালো লাগে। তবে খুব মন খারাপ হয়, যখন দেখি প্রধান বন্দরটিতে ছোটবড় অসংখ্য শূন্য জলযান সার বেঁধে নোঙর করে আছে। স্যুভেনিরের দোকানগুলো খোলা, কিন্তু কোনো ক্রেতা নেই। জনবিরল হালং বেতে এই ভ্রমণ সেরে সন্ধ্যায় ফিরে আসি হ্যানয়ে। পরের দিন আবার ওল্ড কোয়ার্টারে হাঁটতে যাই। নানা দেশের পর্যটকদের সান্নিধ্য ফিরে পেয়ে মন ভালো হয়ে যায়।

টেম্পল অব লিটারেচারের ভেতরে

সাহিত্যচর্চার মন্দির

পরদিন আমরা যে দর্শনীয় স্থানে যাই, তার নাম টেম্পল অব লিটারেচার। এটা আসলে কোনো মন্দির বা ধর্মস্থান নয়। সাহিত্য বা দর্শনচর্চার জন্য কনফুসিয়াসকে উত্সর্গ করা একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে হাজার বছর আগে এর প্রতিষ্ঠা। এতে আছে কনফুসিয়াসের জন্মস্থানের আদলে লেআউট করা অনেকগুলো চত্বর। আর প্রাচীন গাছ ও সবুজ ঘাসে সযত্ন সাজানো বাগান। ছোট ছোট ভবন আর বড় প্রবেশদ্বার প্রাচীন ভিয়েতনামি স্থাপত্য–ঐতিহ্যের অসাধারণ নিদর্শন। তার বৈশিষ্ট্যগুলো আলাদা করে চেনা যায়। এ রকম স্থাপত্যের নিদর্শন দেখেছি হ্যানয়ের আরও কয়েকটি মন্দিরে। ১০৭০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে বহুদিন পর্যন্ত শুধু রাজপরিবার অথবা অভিজাত ব্যক্তিদের সন্তানেরা এই টেম্পল অব লিটারেচারে বিদ্যাচর্চার সুযোগ পেতেন। অনেক পরে সাধারণ পরিবারের মেধাবীদের এখানে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এর প্রায় ৯০০ বছর পর সেই ভিয়েতনাম সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে।

আমাদের চেয়ে ওরা অনেক দিক থেকেই আলাদা। তবু, নতুন পুরোনো মিলিয়ে হ্যানয় শহরটিকে বেশ চেনা লাগে। মানুষদের কিছুটা সংগ্রামী, খুব সহৃদয় আর অনেকখানি আপন মনে হয়।