
ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন সন্ধ্যা ছয়টা। সাতটার মধ্যে আমাকে র্যাডিসন ব্লুতে পৌঁছাতে হবে। ড্রেসআপ করে গিফট বক্সটি হাতে নিয়ে বের হতে ২০ মিনিট কেটে গেল। অবশ্য চকবাজার থেকে র্যাডিসনে পৌঁছাতে ৪০ মিনিট লাগবে না। হেঁটে গেলেও ২০ থেকে ২৫ মিনিটের পথ। তবে গাড়ির শহরে হেঁটে যাওয়ার মানে হয় না। মোটরচালিত এক রিকশায় চেপে বসলাম। লক্ষ্য র্যাডিসন ব্লু। কলেজ গেট। রিকশা আর সামনে এগোচ্ছে না। সামনেও কত গাড়ি! তবে আমার হাতে এখনো আধা ঘণ্টা সময় আছে। আজ থেকে প্রায় আট মাস আগের কথা মনে পড়ছে।
আমি বাসার ছাদে গেলে প্রায়ই এক মেয়েকে দেখতে পেতাম। পাশের ভবনের ছাদে। এককথায় সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, মেয়েটি তা-ই। বয়স ১৭ কিংবা ১৮ হবে। দিন দিন বুঝতে পারি, মেয়েটি আমাকে ফলো করছে এবং ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি অন্য গ্রহের বাসিন্দা!
আমার ঘরের জানালা থেকে অনতিদূরে সামনের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে প্রায় প্রতিদিন গান করে এক মেয়ে। রাত ১১টাই তার গানের সময়। সঙ্গে কেউ থাকে অথবা থাকে না। তবে নিশ্চিত আলো থাকে না। তাই মেয়েটিকে কোনো দিন দেখলাম না। দুই বছর ধরে এ বাসায় আছি। দিনের কিংবা রাতের আলোতে মেয়েটিকে একবারও দেখিনি। রাত ১১টার পর রাতের আলোয় উপস্থিতি অনুভব করা যায় মাত্র। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে খালি গলায় ইচ্ছামতো গান করে। তার গলার সুরটি এতই মধুর যে আমাকে মায়ায় বেঁধে রাখে। তাই আমার দৈনিক রুটিনেও পরিবর্তন এসেছে। এই সময়টি শুধুই তার গান শোনার জন্য বরাদ্দ করে নিয়েছি। শুনতে শুনতে তার গাওয়া একটি গান আমার মুখস্থ হয়ে গেছে—
‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে
জোনাকির আলো নিভে আর জ্বলে শাল মহুয়ার বনে...।’
গানটি হয়তো তার খুব পছন্দের। অবশ্য এখন আমারও। আমি যে প্রতি রাতে তার গানের অপেক্ষায় থাকি, গান শুনতে শুনতে হারিয়ে যাই, কল্পনায় তার ছবি আঁকি; সে কি জানে? হয়তো জানে কিংবা জানে না। কোনো দিন সে ব্যালকনিতে না এলে মন ভীষণ
খারাপ হয়! কোনো কোনো রাতে চোখের পাতায় ঘুমও আসে না।
২৮ আগস্ট অনিকের বড় ভাইয়ের বিয়ে। অনিক আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তার নিমন্ত্রণে সাগর, রিয়ান, আবীদ এবং আমি গিয়েছি মেহেদি রাতে। অনিকদের বাসা আগ্রাবাদ। আমরা তার ঘরে আড্ডা দিচ্ছি। সে আমাদের জন্য কফির ব্যবস্থা করেছে। কফির কাপে এক-দুই-তিন চুমুক দিয়ে চতুর্থ চুমুকের আগেই ভেসে এল খুব পরিচিত একটি কণ্ঠ, পরিচিত একটি সুর, পরিচিত একটি গান, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে...!’ কোলাহলের এই উৎসবে রাতের নির্জনতা এসেছে কি না, জানি না। তবে আমার মনে এসেছে। কফি আর শেষ করিনি। সুরের উৎস সন্ধানে উঠে পড়লাম।
একটি মেয়ে। স্টেজে আপন মনে গান ধরেছে। তার সুরে সুরে আমি বিলীন হয়ে যাচ্ছি। আর থ হয়ে তাকিয়ে আছি। মন বলছে, নিঃসন্দেহে এই মেয়েটি সেই ব্যালকনির মেয়েটিই। শুধু তা-ই নয়, সেই ছাদে দেখা, আমাকে ফলো করা মেয়েটিই এই শিল্পী। একটি গান করেই নেমে যায় অরিন। সে ব্যান্ডের কেউ নয়, অনিকদের আত্মীয়। ও হ্যাঁ, অরিনের পরিচয় তো দেওয়া হলো না। সে-ই আমার স্বপ্নকন্যা।
আজ অরিনের জন্মদিন। তার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর পর এটাই প্রথম জন্মদিন তার। র্যাডিসনে দেখা হবে অরিনের সঙ্গে এবং একান্তই আপন কিছু সময় কাটাব। আমি এখনো পথে। গিফট বক্স হাতে দিয়ে তার হাত দুটি আমার হাতে ধরে রেখে, চোখে চোখ রেখে বলব, ‘হ্যাপি বার্থ ডে...।’