২০–এর শেখা, ২১–এর পত্যয়
‘২০–এর শেখা, ২১–এর প্রত্যয়’ বিষয়ে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল পাঠকের কাছ থেকে। বাছাই করা লেখাগুলো ছাপা হয়েছে স্বপ্ন নিয়ে পাতায়।
অনেক হারানোর, পাওয়ারও বছর
তাসমীম বিনতে হক
দ্বাদশ শ্রেণি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
বছর তো শেষ। এবার নিজেই প্রশ্ন করার পালা—কী পেলাম, কী হারালাম। কতটুকু পথ স্বপ্নের দিকে এগোলাম? ২০২০ যেন এমন এক দুঃস্বপ্ন, যা কখনো কেউ দেখতে চায়নি। জীবন-জীবিকার ওপর আঘাতের একটি বছর পার করলাম আমরা। বছরটা থাকুক আমাদের জীবনে শিক্ষা নেওয়ার বছর হিসেবে। মার্চের শেষে যখন কলেজ-কোচিং সব বন্ধ হয়ে যায়, বাসায় থাকতে থাকতে নিজেকে অনুভূতিহীন, বন্দী কয়েদি মনে হতো। প্রতিটি মৃত্যুসংবাদ আর অনাহারে থাকা মানুষের পরিসংখ্যান কষ্ট দিত। তারপরও ২০২০ বছরটি সুন্দর! ঘরবন্দী হয়ে না থাকলে হয়তো কখনো জানতেও পারতাম না, আমিও লিখতে পারি, নেতৃত্ব দিতে পারি, উপস্থাপনা করতে পারি। এ বছর আমি নিজের একটি ব্লগ ওয়েবসাইট খুলি, যেখানে নিজের ইচ্ছামতো নানা বিষয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ, বিখ্যাতদের জীবনী, বইয়ের রিভিউ দিতে শুরু করি। এই লেখাগুলো আবার আমার ফেসবুক পেজেও দিই। ভালো সাড়া পাই। চেনা-অচেনা অনেকে মেসেজ দিয়ে পরবর্তী লেখা কবে পাওয়া যাবে, তা জানতে চায়। কিছুদিন আগে একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান তাদের সফটওয়্যার নিয়ে আমার ওয়েবসাইটে রিভিউ দিতে মেইল পাঠিয়ে অনুরোধ তরে। এই ই–মেইল আমাকে অবাক করেছে। লেখালেখির প্রতি অনেক আগে থেকেই ভালোবাসা ছিল। কলেজের ক্লাবে লেখালেখি বিভাগের জন্য লিখতাম। তবে আমার লেখার জন্য কেউ অপেক্ষা করবে, অনুরোধ করবে লেখার জন্য, এটা কখনোই ভাবিনি। এখন আমি ঠিক করেছি, পেশা হিসেবে যেটাই বেছে নিই না কেন, লেখালেখি চালিয়ে যাব।
শুধু আমি নই, বছরজুড়ে সবাই কিছু না কিছু করেছে। করোনার এই অখণ্ড অবসরে কিছু একটা করার তাগিদ থেকে আমার বয়সী চেনাজানা অনেকেই ব্যবসা শুরু করেছে। ফটোগ্রাফির প্রতি ভালোবাসা থেকে, পেশাদার ক্যামেরা না থাকা সত্ত্বেও একজন বন্ধুকে পুরোদস্তুর ফটোগ্রাফার হয়ে পুরস্কার পেতে দেখলাম। আবার কেউ তো অনলাইনে নিজেদের নাচ, গান, আবৃত্তির ভিডিও দিয়ে সবাইকে অবাক করে দিচ্ছে। হয়তো আমরা যা করেছি বা যা পেয়েছি, তা তেমন কিছুই না। কিন্তু তারপরও পাওয়াগুলো আমার কাছে অনেক কিছু। কেননা, ২০২০ সালে আমরা আত্মবিশ্বাসী হতে শিখেছি।
ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য প্রস্তুতি
স্বপ্নীল আহমেদ
কৃষি অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
২০২০ সাল আমাদের একলা চলতে শিখিয়েছে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রেখে কীভাবে খুব কঠিন সময় পার করতে হয় এবং জীবনকে এগিয়ে নিতে হয়, সেই উদাহরণ তো আমরা নিজেরাই। ব্যস্ততার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া আমাদের জীবন হঠাৎ থমকে গিয়েছিল মার্চ মাসের লকডাউন শুরু হয়ে যাওয়ার পর থেকে। করোনাভাইরাসের প্রকোপে তখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। ছুটি বাড়াতে বাড়াতে পুরো বছরটাই যখন শেষ হয়ে গেল, তখন একটা প্রশ্ন মনে উঁকি দেয়। বদলে যাওয়া এই সময় আমাদের কী শিখিয়ে গেল এবং এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ কেমন হওয়া উচিত?
প্রথমেই বলতে হয় সুস্বাস্থ্যের কথা। স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে করোনাকাল আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরা, নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, হাঁচি-কাশি দেওয়ার শিষ্টাচার, এই অভ্যাসগুলো সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ।
লকডাউনের এই সময়ে পারিবারিকবন্ধন আরও বেশি পূর্ণতা পেয়েছে। আমরা যাঁরা পরিবার থেকে দূরে থাকি, তাঁরা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর বড় একটি সুযোগ পেয়েছি। পরিবারের মানুষের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধও বেড়েছে। দীর্ঘ এই ছুটি আমাদের একান্ত নিজের জন্য সময় বের করে দিয়েছে। নিজের সঙ্গে সখ্য বেড়েছে। ফলে আমরা আগের চেয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়েছি।
আবার ২০২০ সাল আমাদের প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়েছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম (বাসায় বসে অফিস করা), অনলাইন ক্লাস কিংবা স্রেফ প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের স্বার্থেই নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে আমরা খুব দ্রুতই মানিয়ে নিতে পেরেছি। যেকোনো পরিস্থিতি বা প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার এই ক্ষমতা নিশ্চয় ভবিষ্যতে দারুণ কাজে দেবে।
সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রভাব ফেলুক ২০২০
আবু তালহা
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ
সোনা যেমন আগুনে পুড়ে আরও খাঁটি হয়, ঠিক তেমন ২০২০ সালকে আমরা আমাদের এই সূক্ষ্ম জীবনকে সমৃদ্ধ চলার পথের পাথেয় হিসেবে নিতে পারি।
প্রযুক্তিগত বড় এক শিক্ষা দিয়ে গেল এই মহামারি। আমাদের শিক্ষাকার্যক্রম থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, এমনকি অফিসের বিভিন্ন আলোচনা সভা, সবকিছুই এখন প্রযুক্তিনির্ভর। তাই তথ্যপ্রযুক্তিতে আমাদের আরও দক্ষতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধিসহ সহজলভ্য করার সময় এসেছে।
‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?’ গানের সেই প্রশ্নটিই করোনাভাইরাস আমাদের কাছে ছুড়ে দিয়েছে। কারও মৃত্যুর পর সন্তান ও পরিবার যেখানে মরদেহের কাছে যায়নি, সেখানে স্বেচ্ছাসেবকেরা নিঃস্বার্থভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মরদেহের শেষকৃত্যগুলো সম্পন্ন করেছে। করোনা প্রতিরোধে নিজেদের সাধ্যমতো অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মানবতাবোধের দারুণ উদাহরণ হতে পারে এই ঘটনাগুলো।
আমাদের দেশে উচ্চবিত্ত শ্রেণির অনেকেই চিকিৎসার জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। তবে করোনায় সেই সুযোগ মেলেনি। করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, পরনির্ভরশীলতা সমাধান নয়; বরং দেশের চিকিৎসক, চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর আমাদের ভরসা রাখতে হবে। চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতি সাধনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
তাই ২০-এর শিক্ষাগুলো শুধু আমাদের প্রাত্যহিক ব্যক্তিজীবনে নয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে আমাদের দেশ আরও এগিয়ে যাবে।
প্রযুক্তির ওপর, মানুষের ওপর আস্থা রাখতে চাই
তানজিলা আকতার
চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
ইচ্ছাশক্তিই পারে পুরো জগৎটা বদলে দিতে, এই ধারণা নিয়ে কেটে গেল পুরো ১০ মাস। শেষ হলো ২০২০; যা শুরু হয়েছিল লাখো মানুষের হাসি আর প্রাণঢালা অভিনন্দন দিয়ে আর শেষ হলো অনেকের দীর্ঘশ্বাসে।
আমাদের মনে রাখার উচিত, ধোঁকা দিয়ে বা প্রতারণা করে আর্থিক উন্নতি করার চেষ্টা কখনোই উচিত নয়, বিশেষত এই করোনার সময়ে। দুঃখের বিষয়, এ রকম আমরা একাধিকবার দেখেছি। মানুষ বারবার প্রযুক্তির ওপর আস্থা রাখতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি মানুষেরই লোভের কারণে। ২০২১ সালে আমার প্রত্যাশা, আমাদের এই মানসিকতা বদলাবে। কথায় আছে, ‘জগৎকে তুমি যে চোখে দেখবে, ঠিক তেমনটাই হবে তোমার জন্য।’ মানুষের মনে প্রযুক্তির প্রতি আস্থা দেখতে চাই। সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা সঠিক ফল পেতে চাই।
প্রায় সারা বছর ক্যাম্পাস থেকে দূরে থাকার ফলে বেশ বদলে গিয়েছে জীবন। এই জীবনে প্রতিদিন যা-ই ঘটে, সবই যেন নতুন। তবে করোনার প্রথম দিকে সবার মনে সচেতনতা সৃষ্টি করাটা যেনতেন কথা নয়। এই সচেতনতা সবার মনে ধরে রাখতে হবে। তা ছাড়া একসময় ‘অনলাইন ক্লাস’ নামটাই খুব অদ্ভুত শোনাত, এখন সহজ থেকে সহজতর মাধ্যম এই অনলাইন ক্লাস। এই পদ্ধতি আমাদের ধরে রাখতে হবে। সব মিলিয়ে সফলতা অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তবেই না ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হবে আমাদের প্রত্যয়।
ইতিবাচকতা ধরে রাখতে হবে
সাদিয়া ইসলাম
উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
‘বিষে ভরা’ ২০২০ শেষ হয়ে এল। মহামারি, মৃত্যু আর দুঃখ-দুর্দশার বছর বিদায় নিয়েছে। সঙ্গনিরোধের প্রায় ১০ মাস কাটিয়ে ভালো কিছুর আশায় নতুন বছরের দিকে তাকিয়ে আছি।
তবে দুঃখ–দুর্দশার বিদায়ী বছরের মধ্যেও যদি আমরা ইতিবাচক দিক খুঁজতে যাই, তাহলে চোখের সামনে অনেক কিছুই ভেসে ওঠে। এই ২০২০ সাল আমাদের নিয়ে এসেছে পরিবারের কাছে। আপনজনদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ দিয়েছে।
বাইরের জীবন ছাড়াও পরিবারের প্রতি আমাদের দায়িত্বগুলো নতুন করে উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমরা যারা পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাসায় ভালো আছি, তারা উপলব্ধি করতে পেরেছি যে আমরা কতটা সৌভাগ্যবান।
গেল বছর যেমন কষ্টের অন্ত ছিল না, ঠিক তেমনই ইতিবাচক অনেক কিছুর সূচনা হয়েছে। ইন্টারনেট আর তথ্যপ্রযুক্তিকে নতুনভাবে জানতে শিখেছি। কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতাও আমাদের বেড়ে গেছে। ইতিবাচক শুরুগুলো আমাদের ধরে রাখতে হবে। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, সতর্ক হয়ে হাঁচি-কাশি দেওয়ার অভ্যাসগুলো ধরে রাখতে হবে। এক কথায়, ২০–এর অর্জিত জ্ঞান আর দক্ষতাগুলোর মাধ্যমে নতুন বছরে সবাই নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে, এমনটাই প্রত্যাশা।