অনুপ্রেরণা
৪০ হাজার মানুষকে শরীর গঠনের সবক দিয়েছেন সামছুল আলম
বয়স তাঁর ৭০ বছর। তবে অঙ্গসৌষ্ঠবে নিতান্তই যুবা! ৪৩ বছর ধরে পরিচালনা করছেন নিজের গড়া ব্যায়ামাগার। চিত্রনায়ক থেকে দেশসেরা বডিবিল্ডার, তরুণ থেকে বৃদ্ধ—প্রায় ৪০ হাজার মানুষ তাঁর কাছে পেয়েছে শরীর গঠনের সবক। রাজধানীর মিরপুরের ব্যায়াম প্রশিক্ষক সামছুল আলমের কথা থাকছে এই লেখায়।
দেশের শরীরগঠন (বডিবিল্ডিং) জগতে পরিচিত মুখ রফিকুল ইসলাম। ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ খেতাব জিতেছেন কয়েকবার। অঙ্গসৌষ্ঠব প্রদর্শনের আয়োজনে হাজির হয়েছেন বিদেশেও। সম্প্রতি এই বডিবিল্ডার তাঁর প্রথম ব্যায়াম প্রশিক্ষক সামছুল আলমের কথা লিখেছেন ফেসবুকে। উল্লেখ করছেন, সামছুল আলমের প্রতিষ্ঠিত ফেমাস জিম থেকে বডিবিল্ডিংয়ে তাঁর স্বপ্নযাত্রা শুরুর কথাটি।
রফিকুল ইসলামকে যে মানুষ স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তাঁর খোঁজেই ২৭ অক্টোবর বিকেলে হাজির হয়েছিলাম রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ডে। এখানকার ওসমানী টাওয়ারের তৃতীয় তলায় ফেমাস জিমের কার্যালয়। জিমের অভ্যর্থনা কক্ষে গিয়ে জানলাম, বিকেলের এই সময়টা নারীদের জন্য নির্ধারিত। প্রশিক্ষকও নারী। যাঁর সন্ধানে যাওয়া, তিনি আসবেন মিনিট দশেক পর।
ওসমানী ভবনের নিচে সংক্ষিপ্ত অপেক্ষার পর আবার যখন অভ্যর্থনা কক্ষে গেলাম, তখন দেখা হলো সাকিব আলমের সঙ্গে। তিনি সামছুল আলমের বড় ছেলে। তাঁর সঙ্গে ফেমাস জিমের ভেতরে প্রবেশ করলাম। শরীর ভাঁজতে এসেছেন কয়েকজন স্বাস্থ্যসচেতন তরুণ। তাঁদের কেউ বুকডন দিচ্ছেন, কারও হাতে ডাম্বেল, বারবেল।
ঘুরে দেখলাম পুরো জিম। বড়সড় তিনটি ঘরে শরীরচর্চার নানা সরঞ্জাম। ওয়েট প্লেট, ট্রেডমিল মেশিন, লেগপ্রেস মেশিনগুলো দেখে মনে হচ্ছিল অবসর পেয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে।
এরই মধ্যে এলেন সামছুল আলম। কালো টি–শার্ট পরনে। দুই বাহু জানান দিচ্ছিল পেটানো শরীরের উপস্থিতি। কুশল জানতে জানতেই ডুব দিই তাঁর জীবনগল্পে।
শরীর গড়ে ‘ফেমাস’ হতে চেয়েছিলেন
সামছুল আলমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা মিরপুরে। যখন কৈশোর উত্তীর্ণ সামছুল আলম, তখন দেখতে ছিলেন রোগাপটকা। ওজন ৩৭ কি ৩৮ কেজি। পাড়ার ছেলেপুলে তো বটেই, বন্ধুরাও খেপাত। মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী সেই সময় তিনি কলেজে উঠেছেন। খোঁজ পেয়েছিলেন মণিপুরিপাড়ার এক বিদ্যালয়ে শরীরচর্চার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ‘ওস্তাদ’ হিসেবে ছিলেন জিন্নাহ আমির।
দিন কয়েক শরীরচর্চার পরই নেশায় পড়ে গেলেন। সামছুল আলম বলেন, ‘ডাম্বল ছিল তখন সিমেন্টের দলা, ধোলাইখাল থেকে আনা লোহার চাকতি ব্যবহার করা হতো বারবেলে—সরঞ্জাম এসবই।’ তাই দিয়ে শরীর গঠন হলো সামছুল আলমের। বছরখানেক পর ওজন গিয়ে দাঁড়াল ৫৫ কেজিতে। বাহু উঠল ফুলে। শরীরের সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হলো।
সামছুল আলম বলেন, ‘তখন বিভিন্ন প্রদর্শনী থেকে ডাক পড়তে শুরু করল। ঢাকার বিভিন্ন হোটেল, অঞ্চলভিত্তিক নানা আয়োজনে অঙ্গসৌষ্ঠব প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকত। আমি হাজির হতে শুরু করলাম।’
১৯৭৭ সালের দিকে শরীর গঠনে রীতিমতো পরিচিত মুখ সামছুল আলম। আয়োজন করে শরীরচর্চা তখন যেমন অনেকটা অপ্রচলিত, তেমনি অঙ্গসৌষ্ঠব প্রদর্শনের ব্যাপারটিও। কিন্তু সামছুল আলম চাইলেন শরীরচর্চা করেই তিনি ‘ফেমাস’ হবেন।
ফেমাস বা বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন থেকে ১৯৭৮ সালে নিজের গড়া ব্যায়ামাগারের নাম দিলেন ‘ফেমাস জিম’। অনেকে বলেন, মিরপুরে তো বটেই, নতুন ঢাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে প্রথম ব্যায়ামাগার চালু হয় সামছুল আলমের হাত ধরে।
শুরুতে ভর্তি ফি ২০ টাকা
১৯৭৮ সালে সামছুল আলমের ফেমাস জিমে ভর্তি ফি ছিল ২০ টাকা। মাসিক বেতন সামর্থ্য অনুযায়ী ৫ থেকে ১০ টাকা। এলাকার অনেক তরুণকে দলে ভিড়িয়েছিলেন বিনা পয়সায়।
‘এই ছেলেগুলো কিছুই করত না। সারা দিনে মহল্লায় আড্ডা দিত। সবাই আমার পরিচিত ছিল। ওদের ব্যায়াম করাতাম বিনা পয়সায়। একসময় ছেলেগুলো কর্মঠ হয়ে জীবনে ভালো করেছে’, সামছুল আলম বলছিলেন শরীর গঠন নিয়ে নিজের একাগ্রতার কথা।
সামছুল আলমের প্রতিষ্ঠিত ফেমাস জিমে এখন ভর্তি ফি ২ হাজার টাকা। প্রতি মাসে দিতে হয় ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। কাজীপাড়ার জিমটি ছাড়াও মিরপুরে ১৩ নম্বরে আরেকটি শাখা আছে ফেমাস জিমের। সেখানে সপ্তাহে দুদিন যান সামছুল আলম। হাসিমুখে তিনি নিজেই বলেন, ‘দেখেন, ২০ টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা আজ ২ হাজার টাকা! মানুষের আগ্রহ বেড়েছে, শরীরের প্রতি যত্নবান হচ্ছে। কত আধুনিক যন্ত্রপাতি এখন!’
হাজারো ছাত্রের প্রশিক্ষক
এ পর্যন্ত আপনার ‘ছাত্রের’ সংখ্যা কত?
ইতিউতি মাথা ঘুরি সামছুল আলম বললেন, ‘তা ৪০ থেকে ৫০ হাজার তো হবেই।’
একটু দম নিয়ে আবার যোগ করলেন, ‘এখানেই (তিন বছর আগে চালু হওয়া কাজীপাড়া শাখায়) তো ছয় হাজারের বেশি আছে। দীর্ঘদিন তো প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, সংখ্যাটা অনেক। দেশ-বিদেশ থেকে তাঁরা খোঁজ নিলে আনন্দ পাই।’
বিপুল এই প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে আছেন দেশসেরা অধিকাংশ বডিবিল্ডার, আছেন অভিনয়শিল্পীরাও। তাঁদের মধ্যে প্রথমে বললেন প্রয়াত চিত্রনায়ক মান্নার নাম। জানালেন, হালের শাকিব খানও নিয়েছেন তাঁর সবক। সামছুল আলম বলছিলেন, ‘মহাখালীর ফেমাস জিমে আমি প্রশিক্ষক ছিলাম। সেখানে আমার কাছে শাবনূর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। রিয়াজও নিয়েছেন। দীর্ঘদিন ফেমাস জিমে আসছেন শিবলী (নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ)। এমন আরও অনেকের নামই বলা যায়।’
নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ দুই যুগ আগে সামছুল আলমের কাছে এসেছিলেন। এখনো নিয়মিত আসেন জিমে। শরীরচর্চার গুরু সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘নৃত্যশিল্পী হিসেবে আমি যখন পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেছি, তখন সন্ধান পেয়েছিলাম আলম ভাইয়ের। পরিবেশনযোগ্য শরীর তৈরি করতে পেরেছি তাঁর হাত ধরেই। তিনি একজন অসাধারণ মানুষ।’
বাবার পথে ছেলেরা
সামছুল আলমের তিন ছিল ছেলে বাবার পথেই হেঁটেছেন। বড় ছেলে সাকিব আলম একজন পরিচিত বডিবিল্ডার। বাংলাদেশ গেমসে অংশ নিয়ে বডিবিল্ডিংয়ে দুবার রুপার পদক জিতেছেন, ‘মিস্টার ঢাকা’ প্রতিযোগিতায় জিতেছেন ব্রোঞ্জ। মেজ ছেলে মোহাম্মদ আনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ করে জিমেই প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত আছেন। ছোট ছেলে ইমরান হাসিন কলেজে পড়েন। তাঁরও সময় কাটে জিমে। স্বপ্নও ফেমাস জিম ঘিরেই।
সাকিব আলম বলছিলেন, ‘আমাদের বাড়ির নিচেই তখন জিম। ছোটবেলায় সব সময় বাবাকে দেখেছি জিমে। সারাক্ষণ শরীর গঠন নিয়েই কথা বলতেন তিনি। অবচেতনেই শরীর গঠনে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। বাবাও উৎসাহ দিতেন। অন্য কোনো পেশার কথা কখনো ভাবিনি আমরা।’
স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল
সামছুল আলমের সমবয়সী বন্ধুদের কেউ কেউ রোগে ভুগে চিরবিদায় নিয়েছেন। যাঁরা সুস্থ আছেন, তাঁদের অনেকের শরীরে নানা অসুখের বাস। বয়সের চিরন্তন ধকল সামছুল আলমের শরীরেও পড়েছে। তবে তিনি সুস্থ জীবন যাপন করছেন।
আলাপের শেষবেলায় সামছুল আলম মনে করিয়ে দিলেন চিরসত্য কথাটি, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। জানালেন, তিনি নিয়ম মেনে ঘুমান, নিয়ম মেনে খান, ভোরে ওঠে প্রার্থনা শেষে ব্যায়ামাগারে চলে আসেন। এটাই তাঁর রোজকার রুটিন, সুস্থতার বটিকা। মানুষকে সুস্থ থাকতে হলে ব্যায়াম করতে হবে, শৃঙ্খল জীবন যাপন করতে হবে।