'আহা কী সুন্দর উপমা!'

বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। কাব্য, গদ্য, নাটক, গল্প-উপন্যাস, চিত্রনাট্য, গান—লেখালেখির সব শাখায় শক্তিশালী লেখনী তাঁর। বাবা সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে লিখেছেন তাঁর ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ–হক। এটি এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।
পাশাপাশি সৈয়দ শামসুল হকের লেখা মঞ্চনাটক, চিত্রনাট্য ও গানে কাজ করার অনুভূতি লিখেছেন ফেরদৌসী মজুমদার, কবরী ও এন্ড্রু কিশোর
সেটা ১৯৭৬ সাল, আমরা যখন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় করি। এটাই ছিল আমার প্রথম কাব্যনাটক। নির্দেশনা দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল–মামুন।
আমার মনে আছে প্রথমে তেমন কিছু বুঝিনি। কেমন যেন হচ্ছিল না। হয় কবিতা কিংবা ছড়ার মতো হয়ে যেত, তা না হলে একেবারে একঘেয়ে (ফ্লাট) হতো। কী মুশকিল!
‘গদ্য’ অথচ কী সুন্দর ছন্দ। অদ্ভুত সুন্দর কথাগুলো। এটা হক সাহেবের পক্ষেই লেখা সম্ভব হয়েছে। সবাই পারে না। যেমন রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য আছে। তেমনি আমার নতুন করে পরিচয় ঘটে এমন ছান্দিক সংলাপের নাটকের সঙ্গে।
প্রথমে আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। এত চমৎকার চমৎকার উপমা! সংলাপগুলো প্রথমবার পড়েই মুগ্ধ হয়েছিলাম। বারবার মুগ্ধ হতাম। যত দিন গেছে, তত মুগ্ধ হয়েছি। বিস্মিত হয়েছি। ওনার চিন্তাশক্তি, লেখনীর জোর, ওনার জ্ঞানের পরিধি—সবকিছু আমাকে মুগ্ধ করেছে। সংলাপগুলো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল সত্যি, তবু একসময় নির্দেশককে বলেই ফেলেছিলাম, আমার দ্বারা এটা হবে না। উনি ধমক দিয়ে বলেছিলেন, আপনার দ্বারা যদি না হয়, তাহলে এটা আর কাউকে দিয়ে হবে না। এটা শুনে আমার উৎসাহ আরও বেড়ে যায়।

এ মানুষটির ভাষার ওপর যে কী পরিমাণ দখল, সেটা তাঁর উপমা দেখে মনে হয়। আহা কী সুন্দর উপমা! শেষের দিকের সংলাপের কথা মনে পড়ছে। ‘আমার কি আছে? গ্যাছে সুখ য্যান কেউ নিয়া গ্যাছে গাভীনের বাঁটে যতটুকু দুধ আছে নিষ্ঠুর দোহন দিয়া...।’ ভাবা যায়, তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি কতটা প্রবল ছিল! সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে লন্ডনে বসে লেখা এ বাক্যটি পড়ে কি মনে হয় না, লেখক একটু আগে বাংলার কোনো পাড়াগাঁয়ের গোয়ালঘরে বসে ছিলেন? খুব শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ শক্তি ওনার। নিজের চোখে না দেখলে কেউ এত সুন্দর করে এমন দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে পারে না।ব্যক্তিত্ব এটি ছিল মৌলিক নাটক। আমি ওনার অনেক নাটক করেছি। অনুবাদ কিংবা রূপান্তর। ম্যাকবেথ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, আমি নিজেই লেডি ম্যাকবেথ। এত সুন্দর অনুবাদের ভাষা! শেক্সপিয়ারের ইংরেজিটা যতখানি শক্তিশালী, হক সাহেবের বাংলাটা ঠিক ততখানি শক্তিশালী। অনুবাদ করতে গিয়ে এতটুকু ঢিলেঢালা হয়নি। বেশ সমৃদ্ধ। আমি (লেডি ম্যাকবেথ) ও আলী যাকের (ম্যাকবেথ) প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম সংলাপগুলো সঠিকভাবে ছাড়তে। আসলে হক সাহেবের ভাষাটা আমাদের ঋদ্ধ করেছে। এ নাটকে রাজা-রানির ব্যাপার। রাজার যেমন জৌলুশময় পোশাক, মাথায় মুকুট থাকে, তেমনি ভাষাটাও যেন মুকুট পরা ভাষা হয়েছিল। আহা ভাষার কী আভিজাত্য!
এই তো কিছুদিন আগে যখন শান্তিনিকেতনে যাই, ওখানে হক সাহেব আমাকে বলেছিলেন ‘ফেরদৌসী, আপনি ম্যাকবেথের স্লিপওয়াকটা মুখস্থ করে রাখেন। কোথাও দেখাবেন।’ আমার মতো ওনারও এ দৃশ্যটা প্রিয় ছিল (যখন লেডি ম্যাকবেথ অনুতাপে দগ্ধ ও অসুস্থ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন)। আফসোস লাগছে এটা এখনো আবার নতুন করে ওনাকে দেখাতে পারলাম না। এ মুহূর্তে ওনার আরেকটা অনুবাদের কথা মনে পড়ছে। টেম্পেস্ট। কী অসাধারণ ভাষা। হক সাহেবের ভাষার গুণে কবিতাগুলো গানের মতো হয়ে গেছে।
আমি নিশ্চিত, উনি যা লিখেছেন, আমরা যা করেছি, এর মধ্যেই উনি যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন।
অনুলিখন: মাসুম আলী