'এই জীবনে আর পরালেহা হইল না'

‘যেই দিন শুনলাম বাপে আমার বিয়া ঠিক করছে, সেই দিন বাসা থেইকা পলাইলাম। লুকায় আছিলাম এক নানির বাসায়। কিন্তু আমার বাপ ঠিকই আমারে খুঁইজে নিয়া আইল। এরপর বেরাইতে যাওয়ার নাম কইরে আমারে নিয়া গেল আমার ফুফুর বাড়িত। সেইখানে ফুপাতো ভাইয়ের লগে আমার বিয়া দিল।’ কথাগুলো বলছিল সোহাগী আক্তার। তার বয়স ১৩ বছর। গত বছরের শেষ দিকে যখন সোহাগীর বয়স ১২ বছর ৩ মাস, তখন তার বিয়ে হয়। তার স্বামীর বয়স ছিল ২২ বছর।
সোহাগী তার মা-বাবার সঙ্গে রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বরের গোয়ালবাড়ি এলাকায় থাকে। বাবা স্থানীয় একটি স্কুলের দারোয়ান আর মা এলাকার একটি হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। ৪ অক্টোবর কথা হয় সোহাগীর সঙ্গে। সে জানায়, এই বিয়েতে তার মত ছিল না। কিন্তু তার বাবার ইচ্ছার কাছে তাকে হার মানতে হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত সে। কিন্তু বিয়ের পরই পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ শ্বশুর-শাশুড়ির নিষেধাজ্ঞা। অথচ সোহাগীর ইচ্ছা ছিল অনেক পড়ালেখা করে বড় চাকরি করার।
সোহাগীর বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি দুটিই শেরপুর জেলায়। সোহাগী বলে, ‘বিয়ের পর পরথম পরথম স্বামীরে খুব ভয় পাইতাম। এখন ভয় একটু কমছে। সে ভালা মানুষ। কিন্তু নিজের কোনো আয়-রোজগার নাই। শাশুড়ি খুব রাগী মানুষ। আমারে কইছে ধান ঝাড়তে, গোবর পরিষ্কার করতে। আমি এগুলা ঠিকমতো করতে পারি নাই দেইখা শাশুড়ি আমারে অনেক বকছে। একবার টাইফয়েড জ্বর হইছে। কিন্তু হেরা কোনো চিকিৎসা করায় নাই। খবর পাইয়া বাপে আমারে ঢাকায় লইয়া আসে। এখন বাপ-মায়ের কাছে থাকি। আমার স্বামীও আমার লগে থাকে।’
স্বামী এখনই সন্তান চান কি না? এ প্রশ্নের জবাবে সোহাগী জানায়, তারা পাঁচ বছর পর সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। আর জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সে এখন বড়ি খাচ্ছে। অথচ চিকিৎসকদের মতে, এই বয়সে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
কথা হয় সোহাগীর মা মাসুমা বেগমের সঙ্গে। তাঁর কাছে জানতে চাই, কেন এত কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার তো ইচ্ছা আছিল না। মাইয়ার বাপে বিয়া দিছে। জামাই তো হের নিজের বইনের পোলা। হেই বইন অনেক দিন ধইরা আমার মাইয়ার লগে হের পোলার বিয়া দিবার চাইতেছিল। আর বিয়া না দিয়াই বা কী করুম। এলাকা তো ভালা না। পোলাপাইনে আমার মাইয়ারে খুব বিরক্ত করত। প্রেম করবের চাইত, বিয়ার প্রস্তাব দিত। আমরা স্বামী-স্ত্রী সারা দিন বাইরে থাকি। কখন কী হইয়া যায়। সেই চিন্তা থেইকা বিয়াতে আর অমত করি নাই।’
মাসুমা বেগম আরও বলেন, ‘আশা আছিল এসএসসি পর্যন্ত মাইয়ারে পরাইয়া হাসপাতালে একখান চাকরির ব্যবস্থা করমু। সেইটা আর হইল না।’
সোহাগী বলে, ‘আমি চাই না, আমার মতো অল্প বয়সে আর কোনো মাইয়ার বিয়া হোক। বিয়া না হইলে আমি আরও পরালেহা করবের পাইতাম। এখনো একটা ইচ্ছে আছে। সামনের বছর আবার স্কুলে ভর্তি হমু। কিন্তু মনে হয় না আমার শাশুড়ি রাজি হইব। রাজি না হইলে এই জীবনে আর পরালেহা হইল না।’