'কথায় কথায় সে আমাকে মারে'

‘সকালে কাজ করতে গিয়ে যদি শব্দ হয়, আর এতে যদি তার ঘুম ভাঙে, তাহলে মারতে শুরু করে। কিল, লাথি, ঘুষি মারে যেখানে-সেখানে। গালাগাল করে। তার কোনো কথার প্রতিবাদ করতে গেলে মার খেতে হয়। চুলের মুঠি ধরে মারে। বিছানা ঝাড়ার ঝাড়ু দিয়ে মারে। এমনও হয়, আমার কামিজ টেনে ছিঁড়ে ফেলে। এরপর আবার নতুন পোশাক কিনে দেয়। ছেঁড়া জামা কেটে টুকরা টুকরা করে পুড়িয়ে ফেলে।’
বিবাহিত জীবনের কঠিন সত্য কথাগুলো এভাবেই ব্যক্ত করলেন আফসানা (ছদ্মনাম)। বয়স ৩২ বছর। বিয়ে হয়েছে ২০০০ সালে। স্বামী উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। বয়সের পার্থক্য প্রায় ১০ বছর। দুই ছেলে-মেয়ে তাঁর। বড় মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। আর ছোট ছেলের বয়স দুই বছর।
আফসানা জানান, তাঁর স্বামী বিয়ের পর দুই বছর পর্যন্ত ভালো আচরণ করেছেন। এরপর শুরু হয় নির্যাতন।
কেন স্বামী আপনাকে মারেন?
‘জানি না। আমার ওপর অদ্ভুত আক্রোশ তাঁর। কথায় কথায় সে আমাকে মারে। সে যখন ফোনে কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝতে পারি। কিন্তু জানতে চাইলে মারে। রুম আগোছালো করে রাখলে মারে। যদি কিছু বলি, এমনকি চুপচাপ থাকতে দেখলেও মারে। মারার সময় বলে, “চিৎকার করবি না। আশপাশে লোক যদি জানে, তোকে কিন্তু বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেব।”
আশপাশের কেউ বুঝতে পারে?
‘হ্যাঁ। মারার সময় আশপাশের বাসার কোনো ভাবি এসে যদি কলিংবেল দেন, সে নিজে দরজা খুলে বলে, “ভাবি, আমাদের দুজনের একটু কথা-কাটাকাটি হয়েছে। এর মধ্যে আপনার আসার দরকার নেই। আমাদের বিষয়টা আমরাই দেখি।”এই বলে দরজা বন্ধ করে দেয়। কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয় না। তার কথা হচ্ছে, সারাক্ষণ হাসি-খুশি থাকতে হবে। কীভাবে থাকব বলেন?’
আপনার আত্মীয়স্বজনেরা কেউ জানেন আপনার স্বামীর এই নির্যাতনের কথা?
‘মা নেই। আমার বিয়ের পর বাবাও মারা গেছেন। দুই ভাই আছে ঢাকাতেই। তারা জানে। আমাকে চলে যেতে বলে, কিন্তু আমি যাব না। তাদের সংসারে আমার কী মূল্য থাকবে!’
আফসানার কথা থেকে আরও জানা গেল, তাকে যখন মারধর করে, তখন ছোট ছেলে ভয়ে চিৎকার দেয়। মেয়ে আগে ভয় পেত। এখন আর পায় না। সে আগে মারতে দেখলে তার আব্বুকে ধরে বলত, ‘আব্বু, তুমি আর আম্মুকে মাইরো না।’ কখনো কখনো কাঁদত। তার বাবা ডাকলে কাছে যেতে চাইত না। এখন মেয়েও মাকে মারে। আফসানা মেয়েকে পড়ার জন্য তাগিদ দিলে বা একটু শাসন করলে সে এসে মায়ের চুলের মুঠি টেনে ধরে। কামড় দেয়। হাতের কাছে যা পায় ভাঙচুর করে।
কেন সহ্য করছেন স্বামীর এই মারধর?
‘সহ্য না করে উপায় কী? ছেলেমেয়েকে দেখবে কে? আমার তো আয় নেই। এইচএসসি পাস করার পর বিয়ে হয়েছে। এরপর আর পড়ালেখা হয়নি। এখন স্বামীর ঘর থেকে বের হয়ে গেলে ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোথায় উঠব? খাব কী?
আফসানা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নন। তাই স্বামীর সংসারেই কাটাতে চান জীবনের বাকি দিনগুলো। কথা বলা শেষ হলে আফসানা বলেন, ‘আপা, আমার ছবি কিন্তু দেবেন না আপনাদের পত্রিকায়। তাইলে আমার সংসার ভাঙবে।’