'জাদুর ঘাস'

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের গবেষণা প্রকল্পে অধ্যাপক মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম। ছবি: খালেদ সরকার
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের গবেষণা প্রকল্পে অধ্যাপক মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম। ছবি: খালেদ সরকার

বিন্না ঘাস বাংলার শ্যামল প্রকৃতিতেই জন্মে। তবে গুল্মজাতীয় এই ঘাসই অন্য মাত্রা পেয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ শরীফুল ইসলামের গবেষণায়। তিনি দেখিয়েছেন বিন্না ঘাস ব্যবহার করে কীভাবে স্বল্প খরচে আবাসন, বাঁধ রক্ষা, পাহাড়ধস ঠেকানো এবং নদীদূষণ কমানো সম্ভব। এমন গবেষণার জন্য পেয়েছেন বেশ কিছু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। ২২ জানুয়ারি শরীফুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর বাসাতেই কথা হলো তাঁর গবেষণার নানা দিক নিয়ে।

আলাপের শুরুতেই তিনি বললেন ‘এটা জাদুর ঘাস’। মোহাম্মদ শরীফুল ইসলামের এই জাদুর ঘাসকে আমরা চিনি বিন্না ঘাস নামে। বিদেশে যার পরিচিতি ভেটিভার নামে। তিনি এই ঘাস নিয়েই গবেষণা করেন। শুরুটা ২০০৭ সালে। সে বছরই বাংলাদেশে আঘাত হানে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর। দুর্গত এলাকায় গিয়ে তিনি বোঝার চেষ্টা করেন—কী করে এমন দুর্যোগমুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত বাসাবাড়ি ও রাস্তার ঢালগুলোকে ঠিক রাখা যায়। ঢাকায় ফিরে ইন্টারনেট ঘেঁটে জানার চেষ্টা করলেন ‘লো কস্ট হাউজিং’ (স্বল্প ব্যয়ে বাড়িঘর নির্মাণ) আর ঢাল বা বাঁধ রক্ষার ওপর বিস্তারিত কোনো গবেষণা আছে কি না।

হতাশ হলেন। সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। শরীফুল ইসলাম বললেন, ‘সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা, রাস্তার বাঁধ কিংবা নদীর পাড় বাঁচাতে আমাদের দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে বর্তমানে জিওটেক্সটাইল কিংবা কংক্রিটের ব্লক। যেগুলো নির্মাণ অনেক সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল, আবার লবণাক্ত পানির অঞ্চলে টিকেও থাকতে পারে না। তাই আমি খুঁজতে লাগলাম কম খরচে, পরিবেশবান্ধব ও আবহাওয়া উপযোগী কী প্রযুক্তি এ দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবায়ন করা যায়।’

নাম তার ভেটিভার

অনেক পড়াশোনার পর বাঁধ রক্ষার এক সবুজ প্রযুক্তির সন্ধান পেলেন শরীফুল ইসলাম। হংকং, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে এই প্রযুক্তি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একধরনের ঘাস ব্যবহার করা হচ্ছে এসব দেশে। যে ঘাসকে এক নামে বলা হচ্ছে—ভেটিভার।

খুলনায় বিন্না ঘাস প্রদর্শনী প্লটে শরীফুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
খুলনায় বিন্না ঘাস প্রদর্শনী প্লটে শরীফুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

শুরু হলো ভেটিভারের খোঁজ। ২০০৮ সালের শেষ দিকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা থেকে একজনের ফোন পেলেন, ‘আপনার পাঠানো ছবির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, স্থান চর গঙ্গামতি।’ দুই দিন পরেই চলে গেলেন সেই চরে। মিলিয়ে দেখলেন তিনি, পাওয়া গেল তাঁর কাঙ্ক্ষিত ভেটিভার। স্থানীয় মানুষজন এই ঘাসকে ডেকে থাকে বিন্না নামে।

নিয়ে এলেন সে বিন্না ঘাস। কখনো লবণাক্ত মাটিতে, কখনোবা বালুতে বছরের একেক সময়ে চারা লাগিয়ে ঘাসের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন শরীফুল ইসলাম। তাঁর গবেষণায় বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতা করেছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা।

কী এই ভেটিভার?

ভেটিভার হলো একধরনের ঘাস, যা আমাদের দেশে বিন্না ঘাস নামে পরিচিত। অধ্যাপক শরীফুল জানালেন, এই ঘাসের শিকড় অনেক লম্বা হতে পারে। মাত্র ৪ থেকে ৬ মাসেই মাটির ছয় থেকে দশ ফুট গভীরে শিকড় চলে যায়, চারপাশেও ছড়িয়ে পড়ে অনেক এলাকাজুড়ে।

একটা শিকড়ের সহনশক্তি ইস্পাতের ছয় ভাগের এক ভাগ! অর্থাৎ ছয়টা শিকড় একসঙ্গে করলে এটি ইস্পাতের মতোই শক্তিশালী। অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার নাকি অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এই ঘাসের।

গবেষণায় স্বীকৃতি

২০০৮ সালে ভেটিভার সংগ্রহের পর থেকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন অধ্যাপক শরীফুল। তাঁর গবেষণাপত্রগুলো স্বীকৃতি পেয়েছে নানা জার্নালে। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত রিস্টোর আমেরিকা এস্টুয়ারিজ এবং ২০১১ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন এনভায়রনমেন্টাল, কালচারাল, ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল সাসটেইনেবিলিটি’ সম্মেলনের কথা উল্লেখ করলেন শরীফুল ইসলাম। বললেন, ‘ভেটিভার নিয়ে আমি প্রথম এই দুই সম্মেলনেই গবেষণা প্রবন্ধ পাঠাই আর সেরা গবেষণা প্রবন্ধের স্বীকৃতি পাই।’

দ্য কিং অব থাইল্যান্ড ভেটিভার পুরস্কার নিচ্ছেন শরীফুল ইসলাম (২০১৫)
দ্য কিং অব থাইল্যান্ড ভেটিভার পুরস্কার নিচ্ছেন শরীফুল ইসলাম (২০১৫)

এরপর ২০১২ সালে মালয়েশিয়ায় হওয়া ‘এগ’ (ইঞ্জিনিয়ারিং গোজ গ্রিন) সম্মেলনে সেরা গবেষণা প্রবন্ধের স্বীকৃতি আসে। একই বছর ‘ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স ইনডেক্স’-এর অন্যতম মর্যাদাকর জার্নাল ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভেটিভার নিয়ে তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যা ইন্টারনেট থেকে নামানো হয়েছে প্রায় তিন হাজারবার। দ্য ভেটিভার ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্কের ওয়েবসাইটের হোমপেজে (www.vetiver.org) ছিল এ গবেষণার তথ্য। বিশ্বব্যাপী ভেটিভার নিয়ে কাজ করা গবেষকদের একসঙ্গে নিয়ে এসে প্রতি চার বছর পরপর এক সম্মেলন করে থাকে এই নেটওয়ার্ক। ২০১৫ সালের সম্মেলনে ‘দ্য কিং অব থাইল্যান্ড ভেটিভার অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কার পান অধ্যাপক শরীফুল ইসলাম।

বাংলাদেশে ভেটিভারের প্রয়োগ

লক্ষ্য ছিল ভেটিভারকে দেশের মানুষের কাজে লাগানো। সেই সুযোগ আসে জার্মান উন্নয়ন সংস্থা জিআইজেডের মাধ্যমে। জার্মানির এই সংস্থা সাতক্ষীরা, যশোর, কালীগঞ্জ অঞ্চলে মাছের ঘেরের চারপাশে ঢাল প্রতিরক্ষার জন্য তাঁর পরামর্শ নিয়েছেন। ব্যস, সেই থেকে মাঠের কাজ শুরু।

এরপর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস বাংলাদেশের সহায়তায় বান্দরবান, সাতক্ষীরা, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় স্বল্প ব্যয়ে বাড়িঘর নির্মাণের কাজ করেছেন। গ্রামের মানুষকে নিজ হাতে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, চারা সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন। এদিকে ইফাদ, এডিবি ও কেএফডব্লিউর সঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহায়তায় ২০১৪ সালে তিনি যোগ দেন সিআরআরআইপি প্রকল্পে। যেখানে তিনি সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে বাঁধ রক্ষায় ভেটিভার প্রয়োগের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছেন খুলনা, বরিশাল, বাগেরহাটসহ ১২টি জেলায়। এ ছাড়া হাওর এলাকাতেও বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

২০১৫ সালে ভারতের আসাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড় এবং মাসুলি দ্বীপের পাড় রক্ষার কাজে শরীফুল ইসলামের পরামর্শ নিয়েছে। ব্রাজিলের দুই প্রকৌশলী সেখানকার এক শহরে বাঁধ রক্ষার জন্য তাঁর ক্যালকুলেশন ব্যবহার করে এই ভেটিভার প্রয়োগ করেছেন।

নদীর পাড়ে লাগানো হয়েছে বিন্না ঘাস
নদীর পাড়ে লাগানো হয়েছে বিন্না ঘাস

একটি বেসরকারি সংস্থার আমন্ত্রণে ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি শরীফুল ইসলাম ঘুরে এসেছেন রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। সেখানে নীতি নির্ধারণী সবাইকে পাহাড়ধস ঠেকাতে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। আশার কথা, ঠিক সে সময়ই তিনি ফোন পান জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মোহাম্মদ তালুতের। তিনি জানালেন, ‘কুতুপালংয়ে কিছু চারাও নিজ উদ্যোগেই আমি লাগিয়েছি। আমরা চেষ্টা করছি সরকারের মাধ্যমে বড় পরিসরে এই ভেটিভার লাগানোর কাজ শুরু করতে।’

১৯৭৪ সালে কুমিল্লার কোটবাড়িতে জন্ম নেওয়া এই শিক্ষক হয়তো সে কাজের সঙ্গেও যুক্ত হবেন। এ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনাও আছে। জানালেন, পাহাড়ধস থেকে লাখো মানুষের জীবন বাঁচাতে সরকারসহ অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসা তাই এখন খুব জরুরি। ভেটিভার দিয়ে স্বল্প সময়ে আর স্বল্প খরচে এ কাজ করা সম্ভব।