'টিম ক্র্যাক প্লাটুন'-এর অভিযান

রুয়েটের শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে কোয়াড বাইক। ছবি: সংগৃহীত
রুয়েটের শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে কোয়াড বাইক। ছবি: সংগৃহীত

‘কোয়াড বাইক’টা চলবে খারাপ, উঁচু-নিচু ও পাহাড়ি রাস্তায়। কাজে লাগতে পারে সীমান্ত প্রতিরক্ষায়, বিনোদন পার্কে, কৃষি জমিতে ও মালামাল পরিবহনে। এটি একটি ‘অফ রোড ক্যাটাগরি’র যানবাহন। তৈরি করেছেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) একদল শিক্ষার্থী। স্বাধীনতাযুদ্ধের গেরিলা বাহিনী ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর নামানুসারে এই দলটির নামকরণ হয়েছে ‘টিম ক্র্যাক প্লাটুন’। কোয়াড বাইকটি আবিষ্কারের ঘটনা যেমন মজার, তেমনি এটি নিয়ে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে প্রতিযোগিতায় যাওয়ার কাহিনিও চমকপ্রদ।

রুয়েটের শিক্ষার্থীদের দলটি গত বছরের ২২ অক্টোবর ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে ‘কোয়াড বাইক ডিজাইন চ্যালেঞ্জ-২০১৬’ নামের একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পেয়েছে ‘বেস্ট প্যাশনেট টিম অ্যাওয়ার্ড’। প্রতিযোগিতার ফাইনাল রাউন্ডে ৪৩টি দলের মধ্যে মোট ২৩টি অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। তাদের মধ্যে রুয়েটের অবস্থান ষষ্ঠ।

দলের সদস্যদের ভাষায়, ‘শুরুর দিকের সময়টা কঠিন ছিল। স্পনসরের জন্য বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেও ফল পাইনি। উল্টো অনেকে নিরুৎসাহিত করছিল। যেহেতু দেশে এ ধরনের কাজ খুব একটা হয় না, কিছু কাজ প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছিল। তাই বলে থেমে যাইনি। রুয়েটের মেশিন শপেই কাজ শুরু করে দিই। ৮০ ভাগ কাজ শেষ করার পর আমাদের একটা কারখানার প্রয়োজন পড়ে। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে নিলয়-উসমান মোটরসের রাজশাহীর কারখানায় কাজ করার সুযোগ পাই। এরপর দেখা গেল একটা ইঞ্জিন দরকার। স্যারেরা দেশি কোম্পানি ওয়ালটনের সঙ্গে কথা বলেন। ওয়ালটন আমাদের একটা ইঞ্জিন দিয়ে সহায়তা করে। এভাবে গাড়িটি প্রস্তুত করতে প্রায় তিন মাস সময় লেগে যায়।’

শিক্ষার্থীরা জানালেন, গবেষণাপর্যায়ে প্রথম গাড়িটি বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় ২ লাখ টাকা। তবে বাণিজ্যিক উৎপাদনে এর উৎপাদন খরচ পড়বে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার মধ্যে। তাঁরা মনে করেন, দেশের আমদানিনির্ভর গাড়ির বাজারে এটি বিকল্প হতে পারে।

রুয়েটের শিক্ষার্থীদের তৈরি কোয়াড বাইক
রুয়েটের শিক্ষার্থীদের তৈরি কোয়াড বাইক

এই কাজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন রুয়েটের উপাচার্য ড. মো. রফিকুল আলম বেগ ও সাবেক উপাচার্য সিরাজুল করিম চৌধুরী। উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন ড. মোহাম্মদ এমদাদুল হক ও মো. সাইফুল ইসলাম। দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হচ্ছেন সুমিত কুমার কর্মকার, তাহমিদ জামান খান, মুসা মাহমুদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, শাফিন মাহমুদ, অনিক কামাল, ফারহান খলিল ও আবদুল মমিন। অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মুনিবুর রেহমান ও মশিউর রশিদ।

ভারত-অভিযান

গাড়ি তৈরি করতে যতটা বেগ পেতে হয়েছে, ভারতের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শিক্ষার্থীরা ভুগেছেন তার চেয়েও বেশি। ভিসা-জটিলতা বারবার তাঁদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে। ১৮ অক্টোবর ভারতে রওনা হওয়ার কথা, অথচ আগের দিনও দলনেতা সুমিত কুমারসহ মাত্র দুজনের হাতে ভিসা ছিল। তাই বলে হাল ছাড়েননি। একটা পিকআপ ভাড়া করে পৌঁছে গিয়েছিলেন বেনাপোল সীমান্তে। সেখানে গিয়ে জেনেছেন, সরাসরি গাড়ি নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ নেই।

অনেক অনুরোধের পর সেখানে দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার অন্য একটা উপায় বাতলে দেন। সুমিতকে পাসপোর্টে অঙ্গীকারনামা দিতে হলো। কিন্তু ভারতে প্রবেশ করার পর অভিবাসন কর্মকর্তা আটকে দিলেন। তখন বিকেল পৌনে ছয়টা বেজে গেছে। সীমান্ত বন্ধ হতে বাকি মাত্র ১৫ মিনিট। সুমিতদের সামনে তখন দুটো পথ—গাড়িসহ অথবা গাড়ি রেখে বাংলাদেশে ফিরে আসতে হবে। এত কষ্টে তৈরি গাড়ি রেখে ফিরতে রাজি হননি তাঁরা। গাড়ি নিয়েই ফিরে এসেছেন।

এ ঘটনা জানানো হলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে। তিনি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে পরামর্শ করেন। তাঁরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরদিন যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ১৯ তারিখের ট্রেন ততক্ষণে ছেড়ে গেছে। পরের ট্রেনে গিয়ে আর ২১ তারিখের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া সম্ভব নয়। এরই মধ্যে বাকিদেরও ভিসার ব্যবস্থা হলো। সবাই মিলে আরও নানা ঝক্কি পেরিয়ে পৌঁছলেন ভেন্যুতে।

দলের ক্যাপ্টেন সুমিত বলছিলেন, ‘এরপর শুরু হলো আসল যুদ্ধ। আমাদের গাড়িটা ট্র্যাকে নামানোর জন্য কাজ শুরু করলাম। দুইটা টেকনিক্যাল ইন্সপেকশন পার করলাম সফলভাবে। এ ছাড়া ছিল ব্যবসাসংক্রান্ত কিছু প্রতিযোগিতা। সেখানেও আমরা আমাদের নৈপুণ্য দেখালাম। যখন দেখলাম আমাদের জন্য বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে বিদেশের মাটিতে, সব কষ্ট ভুলে গেলাম।’

এবার টিম ক্র্যাক প্লাটুনের লক্ষ আরও বড়। এরই মধ্যে তারা কাজ শুরু করেছে ‘ফর্মুলা কার’ নিয়ে। প্রতিযোগিতায় যাবেন জাপানে। প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এবার আরও কত রোমাঞ্চ সামনে অপেক্ষা করছে, কে জানে!