
‘নাম কী?’
‘আসল নাম একটা আছে। তয় সবাই ডাকে মন্টু কইয়া।’
‘কোথায় থাকো?’
‘ওই টিচার কোয়ারটারের শ্যাষ মাথায় নীলক্ষেতে ডাসবিনের পাশে। ফুটপাতে ঘুমাই সবাই একলগে চিপাচিপি কইর্যা।’
আমার ফিরতি প্রশ্ন, ‘কেন, তোমার বাড়ি নেই? মা-বাবা নেই?’
বলল, ‘আছে তো! হেরা মোহাম্মদপুরের আদাবরে থাকে। আমার আব্বার রিশকার গ্যারেজ আছে। আটটা ঘর আছে। সেগুলা ভাড়া দ্যায়। আল্লাহ দিলে আব্বার টাকা আছে ম্যালা।’
‘তাহলে তুমি ডাস্টবিনের পাশে থাকো কেন?’
এরপর মন্টু বলে তাঁর জীবনের গল্প।
বয়স তখন পাঁচ কি ছয় বছর। একদিন একটু বড় বয়সী এক বন্ধু ওর হাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিল। সপ্তাহ খানেক পরে ‘ইসপেশাল সিগারেট’ নামে আরেকটা সিগারেট দিল। সেটা খেয়ে ওর মাথা তখনই ঝিমঝিম করতে লাগল। তারপর আর কিছু মনে নেই। দুদিন ঘুমিয়ে কাটাল। পরে নিজেকে নীলক্ষেতের ফুটপাতে আবিষ্কার করল। বয়সে বড় সেই বন্ধু তাকে এখানে এনেছে। তারপর সেই স্পেশাল সিগারেট হরদম খেতে শুরু করল। এরই মধ্যে বড় বন্ধু জানিয়ে দিয়েছে, এই সিগারেট আসলে সিগারেট না, এর ভেতরে গাঁজা আছে। দু-এক দিনের মধ্যেই সঙ্গী হিসেবে জুটে গেল আরও একদল ছেলে, যাদের কোনো বাড়ি নেই, যাদের আকাশটাই বাড়ির ছাদ। আর ফুটপাত বিছানা।
১৩ বছরের মন্টুকে পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে ১২ ফেব্রুয়ারি । তার সঙ্গে ছিল আরও দুই কিশোর। তারা সবাই মাদকাসক্ত।
মন্টুকে জিজ্ঞেস করি, ‘আর কখনো বাড়ি যাওনি? তোমার মা-বাবা খোঁজ করেনি?’
‘কী যে কন, আফা? খোঁজে নাই আবার? সব জায়গায় খুঁজছে। আমারে তো পায় না। আব্বারে চেনে এমন এক লোক আমারে নীলক্ষেতে দেইখ্যা, আব্বারে কইছে। একদিন দেহি আব্বায় আমার সামনে খাড়াইয়া রইছে। তারপর জোর কইর্যা বাসায় নিয়া গেল।’
‘তারপর আবার এলে?’
‘হ, আফা! আমার কিচ্ছু ভালো লাগত না। একদিন, কেউ যখন বাসায় আছিল না, পলাইলাম। এর পরে খুব সাবধানে থাহি।’
‘এখনো কি গাঁজা খাও?’
ওর ফোলা ফোলা লাল চোখ, ক্লান্ত আর রুক্ষ চেহারাই জানান দেয়, ও এখনো মাদকাসক্ত। সে কথাই অবলীলায় বলে, ‘গাঁজার পরে ড্যান্ডিও লইছি। এখন গাঁজা কম খাই। ড্যান্ডিই লই বেশি। ড্যান্ডি হইল, জুতার পেস্টিংয়ের আঠা! ওই যে পেলাসটিকের মতো দেখতে। ড্যান্ডি লইতে লইতে মনে হয়, কইলজ্যাটা এত দিনে পেলাসটিক হইয়্যা গেছে।’
‘কোথায় পাও এসব?’
‘হাতিরপুলের জুতার কারখানা থেইক্যা কিনি। ৬৫ টেকায় এক ডিব্বা পাই।
প্রশ্ন করি, ‘এসব যে শরীরের জন্য ক্ষতিকর, এটা জানো না?’
‘জানি তো, আফা। তয় খাইতে খুব মজা লাগে। খাওয়ার পর নিজেরে পৃথিবীর মালিক মনে হয়। যা মন চায়, করতে পারি। চাঁদের লগে মজা করি। তারারে রকেট মারি। মন চাইলে গাছরে মাটির থেইক্যা আকাশে তুইল্যা ফালাই।’
‘এসব কেনার টাকা পাও কোত্থেকে?’
ঝটপট উত্তর দেয়, ‘বাসে পেপার বেচি। তয় সব দিন না। ধরেন, একদিন বেইচ্যা লাভ করি ৩০০ টেকা। এই টেকা দিয়া কয়েক দিন চলি। তহন কোনো কাম করি না। টেকা শ্যাষ হইলে আবার পেপার বেচি। তয় টেকা না থাকলেও অসুবিধা নাই। বন্ধুরা খাওয়ায়।’
এবার একটু অন্য প্রশ্ন করি মন্টুকে, ‘তোমার বয়সী অন্য ছেলেরা তো স্কুলে যায়, পড়ালেখা করে। তোমার কি কখনো ইচ্ছে করে না ওদের মতো হতে?’
‘ইচ্ছা তো করে। হের লাইগ্যাই তো তিন বছর আগে ব্রাদার রোনাল্ডের লগে আপনগাঁওয়ে গেছিলাম। সেই খানে গিয়া নেশা করা ছাইড়্যা দিছিলাম। কত মজা করছিলাম। সেইখানে পড়ালেখা করতাম, ব্যায়াম করতাম! সুস্থ থাকার কেলাশ নিতো আমাগো। একবার নন্দন পার্কে আর কক্সোবাজার লইয়্যা গেছিল সবাইরে। দুই বছর আছিলাম সেইখানে। নেশা করা ছাইড়্যা দিছিলাম।’
‘তাহলে আবার মাদকাসক্ত হলে কীভাবে?’
‘আপনগাঁও থাইক্যা চইল্যা আইছি দুই বছর পর। হের পরে তিন মাস নেশা করি নাই। ভালা আছিলাম। তারপর আবার এক ভাই খাওয়াইল। তারপর আর ছাড়ি নাই।’
‘বড় হলে কিছু হতে চাও? তোমার কোনো স্বপ্ন আছে?’
এবার চোখ দুটো যেন ঝলমলে তারা হয়ে যায় ওর। বলে, ‘হইতে চাই। সুযোগ পাইলে আমি ইশকুলে পড়তে চাই। তারপর রাস্তায় যেই সব মানুষ ঘুমায়, তাগো সেবা করতে চাই। ব্রাদার রোনাল্ডের মতো। কী কন আফা, পারুম না?’