
প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। আবার ফিরিয়ে আনে আপন ঘরে। এটাই তাদের ব্রত। চলতি পথে রোদ, বৃষ্টি, শত ঘাত-প্রতিঘাত, সিগন্যাল আর যানজট পেরিয়ে নিজের কাজ করে যায় তারা। কিন্তু বিনিময়ে গালাগাল ছাড়া আর কিছুই জোটে না। সাম্প্রতিক সময়ে সেটা বেড়েছে কয়েক গুণ। বিশেষ করে নারী হয়রানির অভিযোগে অভিযোগে জেরবার তারা। এসব নিয়েই কথা হলো সিনিয়র লোকাল বাস মিস্টার লক্কড়ঝক্কড়ের সঙ্গে। বাসভর্তি লোক থাকায় একান্ত সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ‘লোকান্ত’ সাক্ষাৎকারেও উঠে এসেছে চমকপ্রদ অনেক কিছু। সঙ্গে ছিলেন শরীফ মজুমদার
রস+আলো: কেমন চলছেন?
লক্কড়ঝক্কড়: এই মরার শহরে আর চলা! ধুঁকতে ধুঁকতে জীবন শেষ। ঘষা খেয়ে খেয়ে বডির কী
অবস্থা দেখছেন? আর জ্যাম! আমার লাস্ট ট্রিপটার কথাই ধরুন, মিরপুর থেকে ফার্মগেট আসতেই পাক্কা তিন ঘণ্টা পার। ১০-১৫ মিনিটের পথ তিন ঘণ্টা,
ভাবা যায়!
র.আ.: এটা তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, কদিন পর এর চেয়েও বাজে অবস্থা হবে।
ল.ঝ.: তা অবশ্য ঠিক বলেছেন। এখন যে অবস্থা, কিছুদিন পরই হয়তো ঢাকার মানুষ সেই আদ্দিকালের মতো পদব্রজে চলাচল করবে। আর আমরা হয়ে যাব রুটলেস!
র.আ.: ‘রুটলেস’ কি ছিন্নমূল অর্থে বুঝিয়েছেন?
ল.ঝ.: রুটেই যখন চলতে পারব না, তখন সেটাকে তো ছিন্নমূলের মতোই বলা যায়।
র.আ.: আরে না না, এমনটা হবে না। মেট্রোরেল-ফেল কত কিছু হচ্ছে। দেখবেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনারা আগের মতোই সাঁই সাঁই করে চলবেন।
ল.ঝ.: আই হোপ সো। আচ্ছা, ‘সাঁই সাঁই’ নিশ্চয়ই কমপ্লিমেন্ট অর্থে বলেছেন?
র.আ.: হা হা, তা বটে। তবে ইদানীং আপনাদের বেপরোয়া গতি নিয়ে কিন্তু বিস্তর সমালোচনা হচ্ছে।
ল.ঝ.: জানি। মানুষ সব সময়ই কেমন যেন আতঙ্ক আর সন্দেহের চোখে তাকায়। লজ্জায় রাস্তায় বের হতে ইচ্ছে করে না। তবে বেপরোয়া গতির জন্য কিন্তু আপনি কোনোভাবেই আমাদের ব্লেম দিতে
পারেন না।
র.আ.: কেন?
ল.ঝ.: ‘কেন’র হাজারটা উত্তর আছে। প্রথমত, চালক আর তাদের সহকারীরাই সব। আর আপনারা, অর্থাৎ যাত্রীরাও ধোয়া তুলসী পাতা কিন্তু নন!
র.আ.: এমনটা কেন বলছেন?
ল.ঝ.: লোকাল বাসে চড়ার অভিজ্ঞতা থাকলে আপনার এটা জানার কথা। কিছু মানুষ আছে পারলে গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে যায়। আর কোনো রকমে পেছনের গাড়ি সামনে যেতে পারলেই হলো! ‘তোর পিছের গাড়ি সামনে যায় ক্যামনে?’ বলে ড্রাইভারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ে। আপনারা মুখে বলেন ‘স্লো অ্যান্ড স্টেডি উইন্স দ্য রেস’, আর পাবলিক বাসে চড়লেই ‘স্লো অ্যান্ড স্টেডির’ খ্যাতা পোড়েন! এটা কেমন কথা?
র.আ.: আচ্ছা, গতির কথা না হয় বাদ দিলাম। সাম্প্রতিক সময়ে আপনাদের নামে কিন্তু নারীদের হয়রানিরও ব্যাপক অভিযোগ আসছে। এটা নিয়ে
কী বলবেন?
ল.ঝ.: লোকাল বাস হিসেবে আমি অত্যন্ত লজ্জিত। এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। আমার মাঝেমধ্যে ইচ্ছা হয় ব্রেকফেল করে কোনো একটা খাদে গিয়ে আত্মাহুতি দিই! তবে হ্যাঁ,
এখানেও কিন্তু আমাদের বলির পাঁঠা বানানোর কোনো উপায় নেই।
র.আ.: দোষটা তাহলে কার?
ল.ঝ.: আপনার। আপনাদের। একটা কবিতা না কী যেন আছে না, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে লোকাল বাস’!
র.আ.: ইয়ে ‘অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’ না ছিল?
ল.ঝ.: ওই একই হলো। লোকাল বাস আর সর্বনাশ এখন প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। তো কথা হচ্ছে, আপনাদের কারণেই আজ আমরা অভিযুক্ত।
র.আ.: আবারও আমাদেরই দোষ দিচ্ছেন?
ল.ঝ.: নয়তো কী! এই যে নারীরা চলাচলের সময় চরম অনিরাপদ বোধ করে, এর দায় তো আপনাদেরই। আমি স্পেসিফিক কাউকে বলছি না। কিন্তু চালক, সহকারী থেকে শুরু করে এমনকি সাধারণ যাত্রীদের অনেকেরই চিন্তাভাবনা ভয়াবহ! তবে সবাই যে এমন আমি কিন্তু সেটা বলছি না। আর কর্তৃপক্ষের কথা কী বলব! একটা খারাপ ঘটনা ঘটলেই কেবল তাদের টনক নড়ে। ঘটনার পর দায়সারা কিছু একটা করেই খালাস। এভাবে কিছু হয়? কোনো কাউন্সেলিং নেই, সচেতনতা নেই, নারীদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিতকরণে কোনো উদ্যোগই নেই।
ইটস ভেরি স্যাড। অথচ কিছু ঘটলে
দায়টা ঠিকই লোকাল বাসের ওপর
আসে। লোকাল বাস অমুক রে, লোকাল বাস
তমুক রে...
র.আ.: তো, কী করা উচিত বলে আপনার মনে হয়?
ল.ঝ.: প্লিজ ডোন্ট টক রাবিশ। আপনি বিবেক-বুদ্ধিঅলা মানুষ হয়ে একটা লক্কড়ঝক্কড় মার্কা লোকাল বাসের কাছে জানতে চাইছেন কী করা উচিত! ভেরি ফানি। কী করা উচিত-অনুচিত, আপনি কিংবা আপনারা অবশ্যই জানেন। জাস্ট ডু ইট। একটা কথাই বলব, পুরুষ তুমি মানুষ হও।
র.আ.: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ল.ঝ.: আপনাকেও ধন্যবাদ। পারলে আপনাদের ‘লোকাল বাস’ নামের হিট গানটা একটু চেঞ্জ করবেন। ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমরা কাউকে আদর করে তুলিও না, আর ঘাড় ধরে
নামাইও না। যা করার হেল্পারই করে।
সো প্লিজ বি লজিক্যাল।
বি কাইন্ড টু আস।