'ফয়সাল, তুমি তামিম'

দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। স্বপ্ন দেখার শক্তি আর বাস্তবে তা অর্জনের মনোবল হারাননি বাংলাদেশ ন্যাশনাল ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার মো. ফয়সাল। পড়ুন তাঁর অনুপ্রেরণাদায়ী গল্প
লাল–সবুজ জার্সি গায়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন ন্যাশনাল ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলের সদস্যরাও। ছবি: ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত
লাল–সবুজ জার্সি গায়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন ন্যাশনাল ব্লাইন্ড ক্রিকেট দলের সদস্যরাও। ছবি: ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত

আমি কিন্তু আগে দেখতে পেতাম। সেই দিনগুলোর কথা আবছা আবছা মনে পড়ে। তখন আর কত হবে বয়স, দুই বা আড়াই। ১৯৯৭ সালে আমার খুব জ্বর হয়েছিল। কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যংয়ে আমাদের বাড়ি। ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা ওটা। জ্বর হতেই স্থানীয় এক চিকিৎসক আমাকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ দিলেন। সারা গায়ে ফোঁড়া উঠল আমার। আর চোখটাও লাল হয়ে এল। সে সময় থেকে ধীরে ধীরে আমার দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে। এখন তো আর দেখিই না। দাঁড়ান, সানগ্লাসটা খুলে আপনাকে দেখাই।

তো আমার বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ওই স্কুলেই আমি পড়তাম। লেখাপড়ায় আগ্রহ ছিল। কিন্তু লেখাপড়ার থেকেও খেলা আমাকে বেশি টানত। আমাদের বাড়িতে তখন টেলিভিশন ছিল না। রেডিওই সম্বল। আমরা সাত ভাইবোন। সবাই রেডিও শুনতে চাইত। কিন্তু খেলা হলে আমার হাত থেকে আর কেউ রেডিও নিতে পারত না। সেটা ওয়ান ডে হোক বা টেস্ট ক্রিকেটই হোক। আমি বসে বসে ধারাবিবরণী শুনতাম। সব সময় বাংলায় ধারাবিবরণী হতো না, হিন্দি আর ইংরেজিতেও হতো। তা-ও শুনতাম।

মো. ফয়সাল
মো. ফয়সাল

পঞ্চম শ্রেণি পাসের পর আমাকে লোহাগাড়া স্কুলে পাঠানো হলো। ওটা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের স্কুল। শুনতে পেলাম, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের একটা ক্রিকেট টিম হবে। আমার মন নেচে উঠল। বন্ধুবান্ধব ভয় দেখাতে শুরু করল। বলল, অনেক শক্ত বল। গায়ে লাগলে হাড়গোড় ভেঙে যাবে। আমাদের ক্রিকেট খেলার পদ্ধতিটা একটু আলাদা। বলটা ছুড়লে শব্দ হয়। আর ওটা ছুড়তে হয় হাতের নিচ থেকে। আমি কিন্তু বন্ধুদের কথায় একটুও ভয় পাইনি। আমি ক্রিকেট দলে নাম লেখালাম। চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে গিয়ে অনুশীলন করলাম। এরপর থেকে নিয়মিত খেলছি।

ক্রিকেট যে আমার কী, সেটা বোঝাতে ছোট্ট একটা গল্প বলি। ২০১০ সালে আমি মামাবাড়ি থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। শুনলাম ঢাকা-চট্টগ্রাম ম্যাচ হবে। আমার একটা পরীক্ষা ২২ তারিখ, একটা ২৮। খেলাটা এই বিরতির মধ্যেই। মামাকে বললে যেতে দেবে না। বললাম, বাড়ি যাব। এই কথা বলে সোজা চট্টগ্রাম। ততক্ষণে তো আমার মা-বাবা, বড় ভাই, মামা সবাই আমাকে খুঁজতে শুরু করেছে। আমি খেলা শেষে একবারে বাসায় হাজির হব ঠিক করেছি। তাই চুপ করে থাকলাম।

২৪ তারিখ খেলা হলো। ঢাকা ২০ ওভারে ১২২ রান করে ফেলল। ওরা খুবই শক্তিশালী দল ছিল। চট্টগ্রাম ব্যাটিংয়ে নেমে ৫ রানে ৫ উইকেট খুইয়ে ফেলেছে। আর গ্যালারি থেকে দর্শকদের কী গালিগালাজ। তারপর আমি নামলাম। খেলা টেনে নিয়ে গেলাম। দর্শকেরা কী খুশি। আমি শুনছি সবাই চিৎকার করছে, ফয়সাল, তুমি তামিম। ৫ রানে আমরা খেলায় হেরে গিয়েছিলাম। তবে দর্শকেরা ভরপুর আনন্দ পেয়েছিল।

বাংলাদেশ জাতীয় ব্লাইন্ড ক্রিকেট দল। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ জাতীয় ব্লাইন্ড ক্রিকেট দল। ছবি: সংগৃহীত

আমি অন্ধদের জন্য আয়োজিত আন্তর্জাতিক বেশ কটি টুর্নামেন্টই খেলেছি। প্রতিবারই বাসা থেকে বলেছে, এত দূরে কী করে যাবে। শেষ পর্যন্ত আমার জেদের কাছে সবাই হার মেনেছে। ২০১২ সালে ভারতে টোয়েন্টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছি। দুই বছর পর খেলেছি সাউথ আফ্রিকার কেপটাউনে বিশ্বকাপ। এ বছরের জানুয়ারিতে ভারতে বিশ্বকাপ হলো। প্রথম ম্যাচে ভারতের কাছে হারলেও পরে কিন্তু আমরা দারুণভাবে খেলায় ফিরে আসি। আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছি, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকাকেও হারিয়েছি। ভালো খেললে খুব ভালো লাগে। খেলা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তামিম ভাই আমাকে আদর করে দিয়েছিল একবার। ভারতে সৌরভ গাঙ্গুলিও অনেক ভালো ভালো কথা বলেছিলেন। বিদেশের মাটিতে যখন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজে, আমার চোখে পানি চলে আসে।

আমি যেখানেই যাই, বাসার সবার জন্য কিছু না কিছু কেনার চেষ্টা করি। প্রথমেই মায়ের জন্য কিছু কিনি। তবে কিছু কষ্ট তো আছেই। আমরা কোনো মাসিক সম্মানী পাই না। ভারতে যখন বিশ্বকাপ খেলতে গেলাম, তখন বাসে করে কলকাতা গিয়েছি, তারপর প্লেনে। আমাদের খেলার জন্য পৃষ্ঠপোষকও পাওয়া যায় না। যত ম্যাচ হবে, তত খেলার গুণমান বাড়বে। তারপরও বিদেশের মাটিতে শক্তিশালী দেশগুলোকে হারিয়েছি।

দেশ থেকে কেউ যদি একটু অভিনন্দন জানাত, খুব ভালো লাগত। এটুকুই। খেলি তো দেশের জন্যই। যেমন খেলে আমাদের মাশরাফি ভাই, তামিম ভাইরা। মাঝেমধ্যে আমার বাবা বলেন, ‘কীরে ফয়সল, বয়স তো বাড়ছে, তুই কী করবি।’ আমি জবাবে বলেছি, ক্রিকেট নিয়েই থাকব।

অনুলিখন: শেখ সাবিহা আলম