'বনভোজন' রচনা নয়!

বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো খুব বেশি দিন পার করিনি। এর মধ্যেই দারুণ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার মধ্যে একটা হলো—হাসান স্যারের সঙ্গে পিকনিক! বাংলায় যাকে বলে বনভোজন। আক্ষরিক অর্থে বনে গিয়ে ভোজন করার অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি। ছোটবেলায় ‘বনভোজন’ রচনায় পড়েছি (এমনকি লিখেছিও!), বনে গিয়ে রান্না করা, খাওয়া আর গান গাওয়ার নামই হলো বনভোজন। তখন এগুলো হাস্যকর নাটকীয় মনে হতো। আর আজ কিনা আমি নিজেই সেই নাটকের চরিত্র!
সকাল সাড়ে আটটায় ভার্সিটির বাস থেকে নেমে গেলাম ডিপার্টমেন্টে। ওখানে সেলফি-টেলফি তুলে গেলাম ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে কাছের ‘বনে’। ওখানেই হবে আমাদের বনভোজন। গিয়ে দেখি রান্নার সরঞ্জাম আসতে শুরু করেছে মাত্র। একটু পর রান্নার আয়োজন শুরু হলো। আমি কিছুক্ষণ আলু ছেলার চেষ্টা করলাম, কিছুক্ষণ পেঁয়াজ কাটার চেষ্টা করলাম। একটু পর বুঝলাম, পেঁয়াজ কাটার চেয়ে বরং হাত-পা গুটিয়ে সময় কাটানোর কাজটা আমি ভালো পারি! কাজ আমি খুব ভালোবাসি। অতএব ঘুরে ঘুরে সবার কাজ দেখতে লাগলাম! একদল ব্যস্ত রান্নাবান্নায়, আরেক দল ব্যস্ত ছবি তোলায়। কোথাও জমেছে আড্ডা, একটা দল আবার চলে গেছে কাছেই আমবাগান থেকে আম পাড়তে।
কাঁচা আমের মৌসুম তখন। আম এনে কেটেকুটে ভাগাভাগি, কাড়াকাড়ি করে খেলাম সবাই। ওদিকে রান্নাও চলছে। খুব রোদ ছিল সেদিন। জঙ্গলেও গরম লাগছিল। পাতার ফাঁকে রোদ এসে পড়েছিল ঘাসে ঢাকা মাটিতে। দুপুরের আগে স্যার এলেন। এসেই খোঁজ নিলেন আমাদের রান্নাবান্নার। আমাদের হেড বাবুর্চি ছিল শামীমা। মেয়েদের সক্রিয়তা দেখে স্যার বেশ খুশি হলেন, ‘তোমাদের মেয়েরা তো দেখি খুবই অ্যাকটিভ। সব কাজ তো দেখি মেয়েরাই করছে।’ শুনে আমাদের যা গর্ব হলো, মনে হলো যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছি! ছেলেরা একটু প্রতিবাদের চেষ্টা করল কিন্তু মেয়েদের কঠিন যুক্তির কাছে শেষে হার মানল।
একসময় রান্না শেষ হলো। একসঙ্গে বসে ধোঁয়া ওঠা গরম খিচুড়ি দিয়ে খাওয়া সারলাম। বনভোজন রচনায় খাবারে লবণ বেশি হয়, তবু সবাই গোগ্রাসে খায়! আমাদের লবণ ঠিকই ছিল, শুধু একটু গোলমাল হয়েছিল। যদিও মেন্যু ছিল ভুনা খিচুড়ি আর মুরগির মাংস, আমাদের রাঁধুনির গুণে সেটা নরম খিচুড়ি হয়ে গিয়েছিল। তবে সবাই বেশ মজা করেই খেয়েছি। আসল মজা হয়েছিল খাওয়ার পর যখন সবাই মিলে গানের আসরে বসলাম। বকুল ফুল, সোনা দিয়া বান্ধাইয়াছি ঘর, আমার হার কালা করলাম রে, তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা, বায়োস্কোপ, পাগলা হাওয়া, আর নিজেদের বানানো প্যারোডি...নানা স্বাদের গান মিলে গানেরও একটা খিচুড়ি হয়ে গেল! শুধু গিটারই নয়, রান্নার জন্য সঙ্গে আনা পানির ড্রাম, চামচ, গামলা, বোতল এসবও ছিল আমাদের বাদ্যযন্ত্রের তালিকায়। যদিও সেদিন চিৎকার করে গেয়েছি ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’, কিন্তু মনে মনে বলছিলাম, ‘আগের দিন নয়, আজকের দিনটাই সবচেয়ে সুন্দর!’
লেখক: প্রথম বর্ষ, ভূগোল ও পরিবেশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’