'মেয়রের এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি'

গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা
গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা

২৪ জুলাই, ২০১৬ প্রথম আলোর আয়োজনে ‘মেয়রের এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক চট্টগ্রাম কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো

যাঁরা অংশ নিলেন
আ জ ম নাছির উদ্দীন : মেয়র
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

মুহাম্মদ সিকান্দার খান : সভাপতি
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
চট্টগ্রাম জেলা

আবুল মোমেন : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

শাহাদাত হোসেন : সাধারণ সম্পাদক
মহানগর বিএনপি

জেরিনা হোসেন : সাধারণ সম্পাদক
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম

সাফিয়া গাজী রহমান : সমাজকর্মী ও অধ্যক্ষ
সানশাইন গ্রামার স্কুল

প্রকৌশলী আলী আশরাফ : সভাপতি, বাংলাদেশ প্ল্যানার্স
ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার

কলিম সরওয়ার : সভাপতি, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব

এস এম আবু তৈয়ব : সভাপতি, ইন্টারন্যাশনাল
বিজনেস ফোরাম অব
বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার

সিরাজউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর : সাধারণ সম্পাদক,
বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা

খায়রুল আলম : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
বৃহত্তর আগ্রাবাদ জলাবদ্ধতা
নিরসন কমিটি

শুভেচ্ছা বক্তব্য : আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালক : বিশ্বজিৎ চৌধুরী
যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো­

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর উপলক্ষে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে এ বৈঠকের মাধ্যমে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরা এবং যাঁরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছেন তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এ ছাড়া বাকি কাজ ও কোনগুলো করা দরকার, তা তুলে ধরবেন আলোচকেরা। পাশাপাশি নাগরিক সমাজের কী করণীয় তা–ও তুলে ধরতে চাই।
প্রথম আলোর উদ্যোগে এ ধরনের বৈঠক শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামে নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা এমনকি উপজেলা পর্যায়েও করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের কথাগুলো সামনে নিয়ে আসা।

মুহাম্মদ সিকান্দার খান
মুহাম্মদ সিকান্দার খান

মুহাম্মদ সিকান্দার খান: প্রত্যাশা খুব বেশি ছিল না। কারণ, প্রত্যাশা বেশি থাকলে পূরণ হয় কম। যিনি মেয়র হয়ে এসেছেন, তিনি কাজ করতে পারবেন এ রকম একটা আস্থা ছিল। তবে আমি বেশি সুখী নই।
সিটি করপোরেশনের ভেতরে সংস্কার হবে মনে করেছিলাম। কিন্তু কর আদায়ের অবস্থা থেকে বোঝা যায় এর ভেতরে কী চলছে। কেন কর আদায় হবে না? কাকে দিয়ে আদায় করা যাবে? মেয়র না পারলে কে পারবেন। পত্রপত্রিকায় যা আসছে তাতে এই রেকর্ড ভালো না। মাত্র ৩৩ শতাংশ কর আদায় হয়েছে। কর দেওয়ার জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে মেয়রকে। বলতে হবে, কর না দিলে তিনি উন্নয়ন করতে পারবেন না।
আমাদের এখানে মেয়ররা নির্বাচনের আগে বলেন, তিনি নির্বাচিত হলে কর বৃদ্ধি করবেন না। কর দেওয়া ও ধার্য করা আইনের ব্যাপার। লোকজন ফ্লোরেন্সের মতো রাস্তাঘাট চাইবে আবার বলবে করটা একটু কমাও। না দিতে পারলে তো কথাই নেই। সস্তা রাজনীতির কারণে বলে দেওয়া হয়, কর বাড়বে না। এভাবে একটা খারাপ নজির স্থাপন করা হয়েছে।
মেয়রকে তাঁর দায়িত্ব ও ক্ষমতার মধ্যে থেকে কাজ করতে হবে। মানুষ যাতে মেয়রের কাছে সহজে যেতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। মেয়র নগরের উন্নয়নে বরাদ্দ দিতে সরকারের কাছে দাবি জানাবেন। নগরের রাস্তাঘাট সংস্কার, বৈদ্যুতিক বাতি ও নগর পরিচ্ছন্নতার কাজ করবেন। জনগণ যাতে রাস্তা ব্যবহার করে সুখ পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে মেয়রকে।
আর আমরা মেয়রের কাছে বড় বড় দাবি করি। ফলে মেয়ররা নির্বাচনের আগে ইশতেহারে বড় করে তা ছাপিয়ে দেন। নির্বাচিত হওয়ার পর দেখা গেল, চারদিকে মেয়রের হাত বন্ধ। তাই নাগরিক হিসেবে বড় দাবি করার আগে আমাদের চিন্তা করতে হবে, তা করার ক্ষমতা মেয়রের রয়েছে কি না?
চট্টগ্রামের জন্য যে মহাপরিকল্পনা ছিল আগে কোনো মেয়র তা উল্টেপাল্টে দেখেননি। সে অনুযায়ী কাজও করেননি। এখন উড়ালসড়ক নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু উড়ালসড়ক তো মহাপরিকল্পনায় নেই। যেগুলো আছে সেগুলোর কিছুই করা হয়নি। ওই উড়ালসড়ক দিয়ে চমক একটা আছে, এটি করে দিলেই হয়ে গেল। এই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) আমাদের নগর অভিভাবক যা চান, সেটি বুঝে নিয়ে কাজ করতে হবে।

আবুল মোমেন
আবুল মোমেন

আবুল মোমেন: আমাদের তরুণ মেয়র মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পেরেছেন। এটা প্রথম বছরের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করি। মানুষ আশা করতে শুরু করেছে। ফলে দ্বিতীয় বছর থেকে তাঁকে আস্থার প্রতিদান দিতে হবে।
কয়েকটি বিষয়ে নজর দিতে বলব। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য চট্টগ্রাম সারা পৃথিবীতে বিশিষ্ট নগর। পৃথিবীতে এমন কোনো নগর নেই যেখানে সমুদ্র, নদী পাহাড়, বন, হ্রদ—এই পাঁচটি প্রকৃতির দান আছে। নগরের এই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে পারছি না আমরা। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই বৈশিষ্ট্য রক্ষা করার জন্য পরিকল্পনা করা উচিত।
সব সময় বড় বড় উদ্যোগের কথা ভাবি আমরা। ছোট উদ্যোগের কথা ভাবি না কেন? প্রতিটি ওয়ার্ডে একটা করে ছোট ছোট পার্ক হবে না কেন। সবটা পূর্ণাঙ্গ খেলার মাঠও হওয়ার দরকার নেই। বাচ্চারা সেখানে খেলবে। বৃদ্ধরা হাঁটবেন। ওয়ার্ডভিত্তিক একটা করে পাঠাগার হতে পারে। মহিলাদের জন্য বিনোদনকেন্দ্র দরকার।
আরেকটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার। নগর উন্নয়নের কথা বলছি। নাগরিকের উন্নয়নের কথা ভাবি না। বড় নগর চাচ্ছি। আমরা এই নগর রক্ষা করার মতো মানুষ কি না আমাকে সেটিও দেখতে হবে। আমার একটা তত্ত্ব আছে—আমরা এখনো নাগরিক হইনি। আমরা আত্মীয় সমাজে আছি। আমরা আইন, নিয়ম মানতে শিখিনি। নগরে বাস করতে হলে অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। নাগরিকের কীভাবে প্রশিক্ষণ হবে, সেটিও ভাবা দরকার। এই প্রশিক্ষণ না হলে যে যা-ই করুক টেকসই হবে না।
পৃথিবীর কোনো দেশে সব লোক নগরে থাকে না। মুম্বাইয়ে ৬০ লাখ লোক প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে। চট্টগ্রাম শহরের আশপাশে পটিয়া, হাটহাজারী, রাউজানকে উপশহর হিসেবে উন্নয়ন করি না কেন? উপশহর হলে নগরে চাপ থাকবে না। এসব উপশহর থেকে শহরে যাতায়াত করবে মানুষ।

শাহাদাত হোসেন
শাহাদাত হোসেন

শাহাদাত হোসেন: মেয়র প্রথম এক বছরে নগরকে বিলবোর্ডমুক্ত করেছেন। এতে আমরা খুশি হয়েছি। আশা করব, তিনি গ্রিন, হেলদি ও ক্লিন সিটি করার ব্যাপারে যে প্রত্যাশার কথা শুনিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করবেন।
একজন নাগরিক হিসেবে মেয়রের কাছে আমার প্রত্যাশা, তিনি চট্টগ্রামকে একটি নান্দনিক শহর হিসেবে গড়ে তুলবেন, যেখানে টুরিজম থাকবে। এর মাধ্যমে পাহাড়-সমুদ্রের শহরকে তুলে ধরা হবে। আর আমরা যে ঐতিহ্যবাহী শহরকে হারাতে বসেছি, তা–ও ফিরে পেতে চাই।
সবার মূল কথা হচ্ছে চট্টগ্রামের উন্নয়ন। বর্তমান মেয়র নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেটা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু তিনি যখন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, তখন তাঁর অনেক দায়বদ্ধতা রয়েছে।
প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে চট্টগ্রামকে আমরা জলাবদ্ধতামুক্ত ও পরিচ্ছন্ন দেখতে চাই। যখন ছোট ছিলাম তখন চাক্তাই খালের একটি নিশানা ছিল। কিন্তু এখন তা নেই। আরএস ও সিএস অনুযায়ী যেখানে চাক্তাই খাল ছিল, বিএস অনুযায়ী সেখানে খালের নিশানা বদলে গেছে। জলাবদ্ধতার এটি একটি মূল কারণ হতে পারে।
একজন নাগরিক হিসেবে মেয়রের কাছে কী চাহিদা থাকতে পারে, তা অনুধাবন করতে হবে। আগের মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলম এটি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা চাই না ক্ষমতাসীন দলের মেয়র আ জ ম নাছির এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হোন। তিনি নগর উন্নয়নে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের কাজটি শক্তভাবে করবেন। আয়বর্ধক প্রকল্প হিসেবে ওষুধ ও সার কারখানা চালু করা যেতে পারে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে ঢেলে সাজানোর জন্য সব সময় বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছে। নতুন খাল খননে মাত্র তিন কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মেয়র রাস্তা সংস্কারে ১১২ কোটি টাকা চেয়েছেন। কিন্তু এক টাকাও দেওয়া হয়নি। বিশেষ উপহার হিসেবে ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রকে ২০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কী দোষ করল?

জেরিনা হোসেন
জেরিনা হোসেন

জেরিনা হোসেন: সিটি মেয়রের স্বপ্ন ‘গ্রিন সিটি’ ও পরিকল্পিত নগর। কিন্তু ওনার বিভাগে পরিকল্পনার স্থান নেই। আরবান ডিজাইন, ল্যান্ডস্কেপিং কিংবা প্ল্যানিং না থাকলে নগরকে এই লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। সেখানে মেয়রের সক্ষমতা বের করতে হবে।
আপনি নগরের অভিভাবক। অনেকে অনেক রকম কাজ করছে। কিন্তু নগরের দায়ভার আপনার। একজন মেয়র একটা নগর বানান বা ধ্বংস করেন। যে যেটিই করুন আপনাকে অবগত হতে হবে।
সরকার বিনিয়োগ করছে। কিন্তু এটা যেন বৃহৎ জনগণের স্বার্থে হয় সেটি আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে। আমরা দেখছি, সে জায়গায় আপনি নিশ্চিত করতে পারছেন না। যেমন: উড়ালসড়ক। একটা করে দেেখছি, কাজে লাগছে না। দ্বিতীয় ও তৃতীয়টা করে দেখলাম। কাজে লাগছে না। ২ শতাংশ বা তারও কম মানুষের ব্যবহারের জন্য একটা নগরকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। মেয়রকে এই প্রতিবন্ধকতা বা বাধা জনগণকে নিয়ে জয় করতে হবে।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে, মেয়র ট্রেড লাইসেন্স দেন। যদিও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) পরিকল্পনা পাস করে ভবন নির্মাণের ছাড়পত্র দেয়। তবে সিডিএ ব্যর্থ হলে আপনাকে এগিয়ে আসতে হবে। যেমন একটা হাসপাতাল করলে নিচে ৫০ শতাংশ খালি জায়গা রাখতে হবে। যে ছাড়বে না, তাঁকে আপনি ট্রেড লাইসেন্স দেবেন না। গোলপাহাড় মোড়ে এত হাসপাতাল কীভাবে হয়। ওদের গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা কোথায়? অনুমোদন কীভাবে পায়? সিটির মেয়র হিসেবে আপনাকে ওই জায়গায় হাত দিতে হবে। নগরের সবকিছু নিয়ে ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছরের ধারাবাহিক পরিকল্পনা থাকা উচিত।

আলী আশরাফ
আলী আশরাফ

আলী আশরাফ: মেয়রের প্রথম এক বছরে বিলবোর্ড অপসারণসহ কিছু ইতিবাচক কার্যক্রম দেখেছি। এখন অপরিকল্পিতভাবে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। গত এক বছরে ময়লা-আবর্জনা অপসারণে কার্যকর অনেক উদ্যোগ নিয়েছেন। কিছু কাজ শুরুও করেছেন। কিন্তু শেষের দিকে এসে দৃশ্যমান অগ্রগতিটুকু দেখছি না। সেটি কেন হলো তা খুঁজে বের করতে হবে।
জলাবদ্ধতা নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সাবেক মেয়র মনজুর আলমের সময় একনেকে বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন একটি খাল খননের প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু এখনো প্রকল্পের টাকা ছাড় হয়নি। জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিবছর যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়, সে অর্থ দিয়ে ১০টি নতুন খাল খনন করা যাবে। আমরা বারবার ক্ষতিটুকু সয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কাজটি করা হচ্ছে না। গত ২০ বছরে আমাদের কোনো মেয়র মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী কিছু করেননি।
চাক্তাই খাল ঠিক করে দিলে জলাবদ্ধতা নিরসন হয়ে যাবে এ রকম ধারণা রয়েছে। তবে এটি ঠিক না। এখানে বড় বড় আবাসন প্রকল্প করা হয়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে খাল খনন করা হয়নি। নালা করা হলেও পর্যাপ্ত চওড়া করা হয়নি।
এই শহরে ফুটপাত বলতে কিছুই নেই। যা আছে তা–ও দখল হয়ে গেছে। ফুটপাতে মানুষের হাঁটার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তা ছাড়া ৬০ লাখ মানুষের জন্য মাত্র ৪৪টি গণশৌচাগার আছে। এর মধ্যে নারীদের ব্যবহার উপযোগী কোনো শৌচাগার নেই।

সাফিয়া গাজী রহমান
সাফিয়া গাজী রহমান

সাফিয়া গাজী রহমান: যানজটের জন্য গত সপ্তাহে ফ্লাইট মিস করেছি। ইপিজেড পার হতে কোনো কোনো সময় দুই ঘণ্টা লাগে। পরিকল্পনা নিয়ে শহরের যানজট দূর করা উচিত। কিছুদিন ধরে ড্রেন বা খালের ময়লা তোলা হয়েছে। কিন্তু একটা স্তর রয়ে গেছে। ফলে দ্রুত আবার ময়লা জমছে।
চট্টগ্রাম প্রকৃতির দানে সমৃদ্ধ ও পুরোনো শহর। শহরকে চাইলে ভালোভাবে গড়া যেত। পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাহাড় ধ্বংসও হচ্ছে। অথচ গাছ লাগিয়ে আমরা পাহাড় রক্ষা করতে পারি। আমি যেহেতু শিক্ষক, সেই হিসেবে শিক্ষক সমাজেরও ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে বলে মনে করি। কারণ ছাত্ররাই আগামী দিনে নেতৃত্ব দেবে। ছাত্রদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। রাস্তায় ময়লা দেখতে পাব কেন? স্কুল কেন শেখায় না—যত্রতত্র ময়লা ফেলা যায় না। নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। সিটি করপোরেশন তাদের স্কুলগুলোতেও এই সচেতনতা কার্যক্রম হাতে নিতে পারে।

কলিম সরওয়ার
কলিম সরওয়ার

কলিম সরওয়ার: সিটি নির্বাচনের আগে ও পরে মেয়র যে কথাগুলো বলেছেন, আমরা চাইব সেগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করবেন। তিনটি বড় ইস্যু চট্টগ্রাম নগরের জন্য বড় অভিশাপ হয়ে আছে। এই তিনটি হলো জলাবদ্ধতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও বিলবোর্ড সমস্যা। বিলবোর্ডের কথা ধরলে মেয়র শতভাগ সফল। শহর পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের কিছু ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দিনের বেলার পরিবর্তে রাতে ময়লা অপসারণ করা হচ্ছে। তবে খুব বেশি অগ্রগতি হয়েছে বলা যাবে না। তৃতীয় ইস্যু জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতা নিরসনে এখনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি করপোরেশন।
নগরের পরিবহনব্যবস্থা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। এখনো নগরে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা হয় হাতের ইশারায়। গত মেয়রের সময় রাস্তায় সিগন্যাল বাতি বসানো হয়েছিল। পুলিশ বলছে, এসব বাতি ব্যবহারের সুযোগ নেই। অথচ নগর পুলিশের প্রত্যাশা ছিল, পরিবহন ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেওয়া হলে সিটি করপোরেশন ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ যেন তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিক করে। পাশাপাশি আমরা দেখছি চট্টগ্রাম শহরে রাস্তা একটি। এতে বিভিন্ন গতির যানবাহন চলছে। ঠেলাগাড়ি থেকে লিমোজিন সবই। ঠেলাগাড়ির পেছনে লিমোজিন গাড়ি পড়লে সেটির গতিও ঠেলাগাড়ির মতো হয়ে যাবে। এখন ৩৫ মিনিটের দূরত্বে যেতে আমাদের সময় লাগছে তিন ঘণ্টাও।

তা ছাড়া নগরের নিউমার্কেটসহ ব্যস্ত এলাকায় ফুটপাত দখল হয়ে গেছে। হাঁটাচলা করা যায় না। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় এই ফুটপাত দখল হয়। হকাররা বসে থাকে। এ রকম অনেক বিড়ম্বনা আছে। মেয়র অনেকগুলো প্রকল্প নিয়েছেন। যেগুলো বাস্তবায়ন করলে আমরা সবুজ চট্টগ্রাম ফিরে পাব। মেয়রকেও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে হবে।

এস এম আবু তৈয়ব
এস এম আবু তৈয়ব

এস এম আবু তৈয়ব: মেয়রকে দুটি তথ্য দিতে চাই। তিনি বিভিন্ন ফোরামে বলেছেন, অলস সিটি করপোরেশন উত্তরাধিকারে পেয়েছেন। গত এক বছর সেটি নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। দ্বিতীয় বছরে একই কথা বললে মানা যাবে না। আমি বলি, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের সক্রিয় করা দরকার।
মেয়র খাল-নালা খননের উদ্যোগ নিয়েছেন। নালাগুলো খনন হয়েছে ঠিক। আমার কারখানার সামনে নালা পরিষ্কার করে নালার পাড়ে মাটি–আবর্জনা স্তূপ করে রাখা হয়েছে। গত চার মাস ধরে সেই স্তূপ সরেনি। দুদিনের জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য চার মাস ধরে আবর্জনা-মাটিতে আবদ্ধ হয়ে আছি। এই এলাকার কাউন্সিলররা সক্রিয় হলে এই অবস্থা হতো না।
ট্রাফিক নিয়ে দুটি কথা বলতে চাই। আন্তজেলা বাসগুলোকে মূল শহর থেকে বের করে দিন। চট্টগ্রাম শহরের বড় কয়েকটি স্কুলে পার্কিং ব্যবস্থা নেই। যেমন বাওয়া ও খাস্তগীর স্কুলের পার্কিং কোথায়? তাদের মাঠে মেলা হচ্ছে। আর স্কুলগুলোর সামনের রাস্তায় গাড়ি পার্কিং হচ্ছে। আপনি হস্তক্ষেপ করুন। উইলিয়াম কেরি স্কুলে গাড়ি বেশি আসে। কিন্তু তাদের স্কুলের সামনে ট্রাফিক জ্যাম হয় না। কারণ তারা সিস্টেম করে দিয়েছে। নিয়ম ভাঙলে জরিমানা করে তারা। দ্বিতীয় বছরে এই দুটো ব্যবস্থা করতে পারলে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ যানজট কমে যাবে।

সিরাজউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর
সিরাজউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর

সিরাজউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর: চট্টগ্রাম থেকে এক সময় আকরাম-নান্নুর মতো খেলোয়াড় তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন কেন হচ্ছে না? এর সমস্যা কী? বর্তমান মেয়র ভালো মানের খেলোয়াড় তৈরির জন্য একাডেমি করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। আশা করি তিনি এটি বাস্তবায়ন করবেন। আমরা তাঁকে সহযোগিতা করব। ভালো খেলোয়াড় তৈরি ও ক্রীড়াঙ্গনকে সমৃদ্ধ করতে হলে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে হবে।
সাধারণ মানুষের হঁাটাচলা, শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রত্যেক এলাকায় পার্ক থাকা প্রয়োজন। প্রতি ওয়ার্ডে না হোক অন্তত দু-তিনটি ওয়ার্ড মিলে একটি পার্ক করা যায়। এতে অনেক সামাজিক সমস্যা দূর হবে। জাতিসংঘ পার্কের উন্নয়নে কাজ শুরু করলেও একটি পক্ষ সমালোচনা শুরু করেছে। অপ্রয়োজনীয় সমালোচনার কারণে অনেক সময় নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তাই সমালোচনার পাশাপাশি বিকল্প প্রস্তাবও তুলে ধরা উচিত।
আশা করব, মেয়র তাঁর দায়িত্ব পালনের সময় নগরের পার্কগুলো উন্নত করবেন। আর এখানে জায়গার অভাবে পার্ক করা যাচ্ছে না বলে একটি কথা বারবার বলা হয়। কিন্তু রেলওয়েসহ অনেক সংস্থার প্রচুর জায়গা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এখান থেকে জায়গা খুঁজে বের করা কঠিন কিছু নয়। সিআরবি শিরীষতলায় একটি বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলা যায়। সেখানে যাতে মানুষ আসে তার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি এভাবে নাগরিক সুবিধাসহ একাধিক পার্ক গড়ে তোলা যায়, তাহলে চট্টগ্রাম একটি বাসযোগ্য ও সুন্দর নগরে পরিণত হবে।

খায়রুল আলম
খায়রুল আলম

খায়রুল আলম: জলাবদ্ধতা সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে হিমশিম খাচ্ছি। আগ্রাবাদের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মহেশ খাল একসময় অনেক বিশাল খাল ছিল। এটি দিয়ে বড় নৌকা আসত। দখল হতে হতে এটি অনেক জায়গায় সরু নালায় পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া আগ্রাবাদের আশপাশে যে বিলগুলো ছিল তা এখন নেই। সমুদ্রের উচ্চতাও বেড়েছে। এতে আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। গত ১৫-১৬ বছর ধরে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন লক্ষাধিক বাসিন্দা। এই সমস্যা নিরসনে মহেশ খালের মুখে জলকপাট (স্লুইসগেট) নির্মাণ করার কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় মহেশ খালের ওপর সাময়িকভাবে একটি বাঁধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটি নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি হয়েছে। বাঁধ দেওয়ার ফলে এক পাশের বাসিন্দারা সাময়িক স্বস্তিতে আছেন। অন্য পাশের মানুষজন অস্বস্তিতে আছে। তাই তাঁরা বাঁধ ভেঙে দেওয়ার আন্দোলন শুরু করেছেন। আগামী শুষ্ক মৌসুমে জলকপাটটি নির্মাণ করা হলে দুই পাড়ের বাসিন্দারাই স্বস্তিতে থাকবেন। নালা-নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। আবার পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত নালা-নর্দমাও নেই। ফলে খালে যাওয়ার আগেই পানি আটকে যাচ্ছে। খালে পানি নেই কিন্তু লোকালয়ে পানি ভর্তি। এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে।

আ জ ম নাছির উদ্দীন
আ জ ম নাছির উদ্দীন

আ জ ম নাছির উদ্দীন: দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। যে অবস্থায় দায়িত্ব নিয়েছি তাতে নাগরিকদের প্রত্যাশা থাকা স্বাভাবিক। এই প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে। প্রত্যাশা আকাশচুম্বী হলে অপ্রাপ্তির বেদনা তৈরি হয়।
আমি বিলবোর্ড উচ্ছেদ করেছি। দিনের পরিবর্তে রাতে ময়লা অপসারণের ব্যবস্থা করেছি। এ জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কোনো ফল পাইনি। সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১১টা পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ে ময়লা ফেলার জন্য বলা হলেও ময়লা ফেলা হচ্ছে সকালে-বিকেলে। আবার ময়লার স্তূপ দেখিয়ে প্রচার হচ্ছে সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতা। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে ময়লা ফেলার পরও যদি অপসারণ করা না হয় তাহলেই না করপোরেশনের ব্যর্থতা হবে। এরপরও আগামী ১ আগস্ট থেকে সাতটি ওয়ার্ডে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছি। এ জন্য ১০ লাখ বিন (ময়লা ফেলার পাত্র) ও দুই হাজার রিকশাভ্যান দরকার। করপোরেট ও শিল্পপতিদের সহযোগিতা চেয়েছি। সাড়া পেয়েছি কম।
মেয়র হিসেবে আমার প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতাও আছে। নগরে অনেকগুলো সংস্থা কাজ করছে। তারা করপোরেশনের পরামর্শ নিচ্ছে না। নিজেরা প্রকল্প নিচ্ছে। তাদের ডেকে বললেও ফল আসছে না। আইনি কাঠামোতে তারা দায়বদ্ধও নয়।
কর নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। আপনারা বলছেন কর না দেওয়াটা অযৌক্তিক। এই অযৌক্তিক বিষয়গুলোর পক্ষে ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। এখানে অনেকে অনেকবার বিবৃতি, বক্তব্য দিয়েছেন যে সিটি করপোরেশন ট্যাক্স বৃদ্ধি করেছে। অথচ এ–সংক্রান্ত কোনো ক্ষমতা বা এখতিয়ার নেই করপোরেশনের। করপোরেশন শুধু আদায় করতে পারে। কেউ কেউ জনগণকে ট্যাক্স না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ কোনো মিডিয়াতে সঠিক বিষয়টি আসেনি। এই জায়গায় নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।

আমি ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু কোনো দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দায়িত্ব পালন করছি না। শতভাগ সেবার মানসিকতা নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করছি। দায়িত্ব পালনের শেষ দিন পর্যন্ত এই মানসিকতা ধরে রাখব। সর্বোপরি এটা আমাদের নগর। বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় নগর। চট্টগ্রাম এগোলে বাংলাদেশ এগোবে। চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারবে না। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে।